আলাউদ্দিন খিলজি সমগ্র ভারতবর্ষকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, যা হয়তো অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো না।
আলাউদ্দিন-খিলজি ছিলেন খিলজি বংশের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। যিনি দিল্লিতে বসে ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজি শাসন পরিচালনা করতেন।
তিনি মূলত দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের রণ কৌশলের উপর ভিত্তি করেই তার সামরিক শক্তিকে সাজিয়েছিলেন। সমর কৌশলে খিলজি ছিল অসাধারণ দক্ষ এবং বিশ্বমানের এক বিরল সামরিক প্রতিভা। রণক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন নিজের অভাবনীয় উদ্ভাবনী সমর কৌশল। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় ইতিহাসেও একজন আলেকজেন্ডারের মতো শক্তিশালী কারো কথা উল্লেখ করা থাকুক। তাই তিনি নিজেকে ২য় আলেকজেন্ডার (সিকান্দার-এ-সানি) হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালিয়ে যান।
খিলজির জন্ম ১২৬৬ সালে দিল্লিতে। তিনি ছিলেন খলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান জালালউদ্দিনের জ্যেষ্ঠ ভাই শিহাবুদ্দিন মাসউদের জ্যেষ্ঠ ছেলে অর্থাৎ খিলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালুদ্দিন খিলজির ভাতিজা এবং আত্মজার জীবন সঙ্গি।
আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লীর সুলতান ছিলেন ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ সাল পর্যন্ত। তিনি তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেন চিতোর, দেবগিরি, বারাঙ্গাল (যেখান থেকে তিনি কোহিনুর হীরাটি সংগ্রহ করেছিলেন), গুজরাট, হইসলা রাজ্যগুলো নিয়ে। তিনি ভারতবর্ষের এমন এক দুঃসময়ে ক্ষমতায় আসেন, যখন ভারতবর্ষের সীমান্তে শোনা যাচ্ছিলো নিষ্ঠুর মঙ্গোল সৈন্যদের অশ্বের ভীতিকর খুরের পদধ্বনি। ভারতের সীমানায় ছিল মঙ্গোলদের ধারালো তরবারির মুহুর্মুহু ঝলকানি। মঙ্গোল আক্রমণের আশংকায় দেশটি হয়ে পড়েছিল ভীতসন্ত্রস্ত এবং অস্থির।
মামলুকদের পরাজিত করে জালালউদ্দীন যখন দিল্লীর সুলতান হলেন, তখন আলাউদ্দিন খিলজিকে তিনি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের প্রধান (আমির-ই-তুজক) নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে, ১২৯১ সালে আলাউদ্দিন খিলজি কারা রাজ্যের গভর্নর এবং ১২৯৬ সালে ভিলসার সফল অভিযানের পর আওদের গভর্নরও নিযুক্ত হন। ঐ বছরেই তিনি দেবগিরি আক্রমণ করে সুলতান জালালউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দিল্লীর ক্ষমতা দখল করেন। আলাউদ্দিন খিলজি তার মামা এবং শ্বশুর সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করেন এবং মুলতানে থাকা জালালউদ্দিনের পুত্রদেরও দমন করেন কঠোরভাবে। এভাবেই আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লীর সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মঙ্গোলরা সাধারণ আক্রমণকারী ছিল না। আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই মঙ্গোলরা তখন কতটুকু নিষ্ঠুর এবং ধ্বংসাত্মক ছিল। মঙ্গোলরা অন্য দেশ জয়ের পর সে দেশের সব পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করতো। নারীদের করতো অপহরণ এবং কোন দেশ জয় করে কেবলমাত্র লুন্ঠন এবং হত্যা করেই থেমে থাকতো না, পুরো দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতো। সেখানে সভ্যতার কোন চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
খিলজি মঙ্গোলদের সাথে কখনোই কোন আপস করেননি। যদিও মঙ্গোলদের দাবি পূরণ করা তখন তার জন্য ছিল অনেক সহজ। তিনি সহজ পথটি ছেড়ে কঠিন পন্থাটিই বেছে নিয়েছিলেন- মঙ্গোলদেরকে সরাসরি মোকাবেলা করা। তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, ভারতবর্ষের সীমানা থেকে মঙ্গোলদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা না পর্যন্ত বিশ্রাম নিবেন না। তার সেই অঙ্গীকার তিনি রেখেছিলেন পুরোপুরি।
আলাউদ্দিন খিলজির শাসনামলে মঙ্গোলরা পরপর ছয় বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এবং দু’ বার ছিলো দিল্লী দখলের ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু ছয় বারই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় মঙ্গোলরা।
মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় সন্তান চাগাতাই খান ভারত আক্রমণ করে কয়েকবার। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির নির্দেশে ১২৯৮ সালে তার ভাই জেনারেল উলুঘ খান মঙ্গোলদের পরাজিত করেন। ১২৯৯ সালে তারই আরেক জেনারেল জাফর খানের সাহসিকতায় সিন্ধু এলাকায় মঙ্গোলদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে তাদেরকে বিতাড়িত করেন ভারতের সীমানা থেকে। মঙ্গোলরা ১২৯৯ শতাব্দীতে দিল্লী আক্রমণ করলে, খিলজি নিজেই তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ১৩০৫ সালে মঙ্গোলরা আবারো ভারতবর্ষ আক্রমণ করলে, আলাউদ্দিনের সামরিক জেনারেল মালিক নায়ক তা প্রতিহত করে ভারতবর্ষকে রক্ষা করেন মঙ্গোল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে।
১৩০৬ সালে প্রায় এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে মঙ্গোলরা ষষ্ঠবারের মতো ভারতবর্ষ আক্রমণের জন্য ইরাবতী বা রাঘি নদীর তীরে অবস্থান নেয়। মঙ্গোলদের এই সৈন্য সমাবেশ ছিল বিশাল, ভীতিকর এবং মনে হচ্ছিলো অপ্রতিরোধ্য। ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে মঙ্গোল-ভীতি। মনোবল ভেঙে যায় বেশিরভাগ মানুষের, এমনকি খিলজির সভাসদদেরও। খিলজির তৎকালীন সভাসদরা তখন তাকে মঙ্গোলদের সাথে শান্তিচুক্তির পরামর্শ দেয়। কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ঐ যুদ্ধে খিলজির নেতৃত্বে তার সমর নেতা মালিক কাফুরের কাছে মঙ্গোলরা এমন নিদারুণভাবে পরাজিত হয় যে, মঙ্গোলদের মোট এক লক্ষ সৈন্যের মধ্যে মাত্র তিন-চার হাজার প্রাণ নিয়ে পালতে সক্ষম হয়। আলাউদ্দিন খিলজির কঠোরভাবে মঙ্গোল দমনে পরবর্তী দশ বছর ভারতবর্ষে আর কোন মঙ্গোল আক্রমণ হয়নি।
আলাউদ্দিন খিলজি সমগ্র ভারতবর্ষকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, যা হয়তো অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। সেই সময় তিনি দৃঢ়ভাবে মঙ্গোলদের প্রতিহত না করলে, আজ হয়তো ভারতবর্ষকে দু’তিন শো বছর পেছনে পড়ে থাকতে হতো। মঙ্গোলদের দমন করার মাধ্যমে ভারতকে তিনি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
বিজেতা হিসাবে আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন দিল্লির সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । স্যার উলসলে হেগের মতে, তার রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই সুলতানি সাম্রাজ্যবাদের সুত্রপাত হয় । তার আমলেই প্রথম দক্ষিণ ভারতে সুলতানি সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে । বিজেতা হিসাবে অনেকে তাকে আকবরের সঙ্গে তুলনা করেন। আলাউদ্দিনের দৃঢ়তা ও তার অসীম সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধকৌশলের কারণে তিনি ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছেন।
উৎসঃ লেখিকা শান্তা আনোয়ার ফেইসবুক পেইজ থেকে।
আরও পড়তে পারেন : বউ পেটানোর মজা!
আলাউদ্দিন খিলজি সম্পর্কে আরও জানতে নিচের লেখা গুলো পড়তে পারেন!
০১. আলাউদ্দিন খিলজি : উইকিপিডিয়া
০২. আলাউদ্দিন খিলজি: ইতিহাসের এক নায়ক, না খলনায়ক?| মানব জমিন
০৩. সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি এবং ‘অকৃতজ্ঞ’ ভারতবাসী! – Naya Diganta
০৪. যে ভারতীয় শাসক ৬ বার মোঙ্গলদের পরাজিত করেছিলেন – Roar bangla
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.