প্রিয় পাঠক পাঠিকা, লেখকের আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ বইয়ের ২৩, ২৪ ও ২৫ তম গল্পগুলি একসাথে এখানে তুলে ধরেছি। যাতে লেখকের তিনটি আত্মশুদ্ধি মূলক লেখাগুলি একসাথে পড়তে ও বুঝতে পারেন। তাহলে চলুন শুরু করি…
২৩. স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটাতে সচেষ্ট হউন☺
প্রিয় ভাই! স্ত্রী সবসময়ই স্ত্রী। তরুণী, বৃদ্ধা, সুন্দরী, কালো যা-ই হোক নাম কেন , স্ত্রী সবসময়ই আদর-সোহাগের পাত্রী। তাই কোনো কারণে যদি আপনার কোনো কথা বা কাজের দ্বারা তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয় তাহলে দেরী না করে সাথে সাথে তার নিকট গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিন। তাকে বলুন যে, আজ থেকে তোমার সাথে আমি যে আচরণ করব, তা শুধু স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং আল্লাহর বান্দী মনে করে সর্বদা তোমার সাথে সুন্দর আচরণ করব। আমার মেয়ের ব্যাপারে আমি যেরূপ চিন্তা করি যে, জামাতা যেন সাথে উত্তম ব্যবহার করে, তার দোষ – ক্রটি ক্ষমা করে দেয়, তদ্রুপ আজ থেকে আমিও তোমার সাথে উত্তম ব্যবহার করব, তোমার দোষ – ক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখব এবং তোমাকে কোনো প্রকার কষ্ট দিব না। যদি আমার অজান্তে আমার দ্বারা তুমি কোনো কষ্ট পেয়ে থাক তাহলে আমাকে বলিও। যাতে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারি। আমি এখন থেকে তোমার ভুল – ক্রটির অগ্রিম ক্ষমা ঘোষণা করছি। সেই সাথে এই প্রতজ্ঞাও করছি যে, আর কোনোদিন তোমাকে কাদাঁব না। তোমার সাথে আঘাত দিব না।
মোটকথা, যে কোনোভাবে স্ত্রীকে খুশী করার চেষ্টা করুণ। সম্ভব হলে এক দু’শ টাকা হাদিয়া দিন। এবং বলুন যে, আমার কারণে আজ তুমি কষ্ট পেয়েছ, কান্না করেছ, তাই আমার পক্ষ থেকে এ টাকাটা তোমাকে প্রদান করলাম। এ ধরণের ভুলের জন্য ভবিষ্যতে আরো বেশী হাদিয়া দেব..ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় ভাই! আপনি যদি এভাবে স্ত্রীকে বলতে পারেন, তাহলে আপনিই বলুন তো, তার মনে কি কষ্ট থাকবে? নিশ্চয় না। বরং সে তো তখন আপনাকে আরো বেশী শ্রদ্ধা করবে, আরো বেশী ভালোবাসবে। আপনার মতো স্বামীর জন্য সে তখন শুধু যৌবন নয়, জান দিতেও প্রস্তুত থাকবে। তাই দ্বন্দ – সংঘাতের পথে না গিয়ে হাসি-খুশির সাথেই দাম্পত্য জীবনটা কাটানোর চেষ্টা করুণ। এর ফলে আপনি মানসিক শান্তি পাবেন, কাজে উদ্যমতা লাভ করবেন। সর্বোপরি, আল্লাহর ইবাদতের মধ্যেও আপনি এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করবেন।
প্রিয় দ্বীনি ভাই, তাই স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটাতে সচেষ্ট ও যত্নবান হোন। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটানোর তাওফীক দান করুক ও সুখময় দাম্পত্য জীবন উপহার দিক। আমীন।
২৪. স্ত্রী পক্ষের আত্মীয় – স্বজনদের প্রতিও খেয়াল রাখুন
পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা ১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যার নামের ওসিলা দিয়ে তোমরা একে অপরের নিকট কিছু চেয়ে থাক। এরপর তিনি বলেন-যার ভয় দেখিয়ে তোমরা অন্যদের কাছে কিছু চেয়ে থাক বা নিজের হক দাবী করে, সেই আল্লাহর ভয়ে তোমরা তোমাদের আত্মীয় – স্বজনদের হক আদায় করো এবং তাদের হক নষ্ট করা থেকে বিরত থাক।
৪:১ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَ بَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِهٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ رَقِیۡبًا ﴿۱﴾
এ আয়াতে আল্লাহ পাক ‘আরহাম’ শব্দ উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ লোক ‘আরহাম’ বা রক্ত সম্পর্কীয় বলতে নিজের মা, বাপ, ভাই-বোনের সম্পর্ককেই বুঝে থাকে। অর্থাৎ কেবল মাত্র মা-বাপ, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী প্রমুখকেই রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় – স্বজন মনে করে থাকে। তারা স্ত্রীর আত্মীয় –স্বজনকে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় মনে করে না। অথচ আল্লামা সাইয়েদ মাহমুদ আলূসী (রহ:) তার তাফসীরে রূহুল মাআনীতে ‘আরহাম’ শব্দের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন- ‘আরহাম’ বা রক্ত সম্পর্কীয় বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা নিজ বংশ বা খান্দানের মানুষ এবং তাদেরকেও বুঝায় যারা স্ত্রী পক্ষের আত্মীয়। যেমন-শ্বশুর, শাশুড়ী এবং স্ত্রীর ভাই, বোন প্রমুখ।
সুতরাং নিজের মা-বাপ, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী ইত্যাদির মতো স্ত্রী মা-বাপ, ভাই-বোনের প্রতিও সবিশেষ খেয়াল রাখুন। তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করুণ। মনে রাখবেন, স্ত্রীপক্ষের লোকদেরকে অসম্মান, অপমান কিংবা অবজ্ঞা করে কখনোই স্ত্রীর মন পাবেন না। তারা যদি গরীব হয় আর আল্লাহ পাক আপনাকে স্বচ্ছল করে থাকেন তাহলে অভাব মোচনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করুণ। মূলতঃ স্ত্রীপক্ষের আত্মীয়দের দেখাশুনা ও তাদের অভাব-অনটন দূর করার নামান্তর। স্মরণ রাখবেন, স্ত্রী পক্ষের আত্মীয়-স্বজনরা যদি অনাহারে, অর্ধাহারে রাত কাটায় আর আপনি পেট পুরে খানা খান এবং তাদের কোনো খোঁজ-খবর না রাখেন কাল-কিয়ামতে অবশ্যই আপনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাই এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিৎ।
২৫. স্ত্রীর উপর সবসময় হুকুমত দেখাবেন না।
অনেক লোক কথায় কথায় সামান্য কারনেই স্ত্রীর উপর হুকুমত দেখিয়ে থাকেন। তাদের প্রতিটি কাজ কর্মেই হাকীম বা শাসকের ভাব মূর্ত হয়ে উঠে। যেমন, শাশুড়ী অসুস্থ। স্ত্রী শাশুড়ীর কাছে আছে। তার খেদমত করছে। ইতোমধ্যে স্ত্রীকে নেওয়ার জন্য জামাই এসে হাজির। শাশুড়ী বললেন, বাবা! আমার তো খুব দাস্ত হচ্ছে। মেয়েটা আমার দেখাশুনা করে, খেদমত করে। খাবার পাকিয়ে খাওয়ায়। তাই, ওকে এখন না নিয়ে দু’দিন পর এসে নিয়ে যেও। উত্তরে জামাতা বলল-না, তা হবে না। তা হতে পারে না। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর আপনাদের হুকুমত শেষ। আপনাদের কোনো কথা এখন চলবে না। ও অধিকার আল্লাহ পাকই আমাদেরকে দিয়েছেন! আপনারা কি জানেন না যে, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক কী বলেছেন? আল্লাহ পাক বলেছেন-আর রিজা-লু—পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল ও তার পরিচালক।
আরে ভাই! আপনি তো আপন স্বার্থে সিদ্ধির জন্য পবিত্র কুরআনের আয়াত ভালোই মুখস্থ করেছেন। সেই সাথে আপন প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের কথা সগৌরবে বলে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমি বলি, এটা কি হুকুমত? এটা কি কর্তৃত্ব? নাকি চরম নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা? আচ্ছা আপনি বুকে হাত রেখে বলুন তো, যদি আজ আপনার মা অসুস্থ হতেন তাহলে আপনি কী করতেন? তখন তো আপনি নিশ্চয় এমন নিষ্ঠুরতা ও নালায়েকী প্রদর্শন করতেন না। তাই সেখানে যা করতেন এখানেও তাই করুণ। বাসায় স্ত্রী না থাকার কারণে রান্নাবান্নার সমস্যা হলে নিজের হাতে রান্না করুণ কিংবা হোটেল থেকে খেয়ে নিন। আচ্ছা বলুন তো, আপনার স্ত্রী যদি তার মায়ের কাছে আরো দুই একদিন থেকে তার খেদমত করে তাহলে আপনার এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে? আপনি কি একবারও চিন্তা করে দেখলেন না যে, যিনি কষ্ট করে ষোল সতের বছর তার মেয়েকে লালন পালন করেছেন, বিয়ের পর কি তার সমস্ত হক খতম হয়ে গেছে? কখনো না।
আপনার শশুড়ী যখন তার মেয়ের ব্যাপারে আবদার করেছেন তখন তো আপনার উচিৎ ছিল কুরআনের আয়াত না শুনিয়ে, নিজের কর্তৃত্বের কথা জাহির না করে তাকে সাথে সাথে বলা যে, আম্মা! এক দু’দিন কেন? চার-পাচ দিন থাকুক। প্রয়োজনে আরো বেশী থাকুন। যখন আপনার শরীর পুরোপুরি সুস্থ হবে তখন তাকে নিতে আসব। সেই সাথে এও বলুন, আম্মাজান! আমিও আপনার খেদমত করব। চলুন আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। বলুন আপনি কী খাবেন? আপনি আমাকে আপনার মেয়ে দিয়েছেন, তার মানে কলিজার টুকরো দিয়েছেন। মেয়ে তো আপনি এমনিতেই পাননি। কত কষ্ট করেছেন এই মেয়ের জন্য।
এবার আপনি যে আয়াত পেশ করে স্বীয় কর্তৃত্ব হাজির করেছিলেন সে আয়াত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনুন। এ আয়াত প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক সাহেব (রহঃ) বলেন-অবশ্যই স্ত্রীর উপর স্বামীর হুকুমত বা শাসনাধিকার আছে। তবে তা শরীয়তের ব্যাপারে। অর্থাৎ স্ত্রী যদি শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজ করতে চায়-যেমন, সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হলে নিয়ে যেতে বলে, টেলিভিশন, ভিসিআর কিনে দিতে বলে, ঘরে কোনো প্রাণীর ছবি টানাতে বলে ইত্যাদি-তখন আপনি নিজের শাসনাধিকার প্রয়োগ করুণ। কঠিন কণ্ঠে বলুন যে, আমার দ্বারা এই কাজ কম্মিনকালেও হবে না। মনে রেখো, তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি সবকিছু করতে পারি, কিন্তু গোনাহের মধ্যে জড়াতে পারি না। কারন এতে আমার মাওলা আল্লাহ পাক নারায হবেন।
কিন্তু যদি স্ত্রী বলে যে, আমার জন্য এক কেজি আপেল নিয়ে আসুন, তখন আপনি হুকুমত জাহির করে একথা বলতে পারবেন না যে, আমার দ্বারা আপেল আনা সম্ভব নয়। আমি যখন ইচ্ছে করে আনব তখনই তুমি খাবে। আমার ইচ্ছার বাইরে আমাকে তুমি কিছু বলতে পারবে না। অবশ্য অসুস্থতা বোধ কিংবা অন্য কোনো বিশেষ ওজর থাকলে স্ত্রীকে একথা বুঝিয়ে বলতে পারেন যে, আমার শরীরটা এখন খুব খারাপ লাগছে। একটু পরে বা বিকালে এনে দিব। মোটকথা, এক্ষেত্রে স্ত্রীর উপর হুকুমত জারী করা যাবে না। বরং সমস্যা থাকলে সমস্যার কথাটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। যাতে সে সান্ত্বনা পায় এবং মনে কোনো কষ্ট না লাগে। মনে রাখবেন, স্ত্রীর সাথে আপনার এক সম্পর্ক হাকীমের এবং আরেক সম্পর্ক প্রেমিকের। হাকিম বা শাসক হিসেবে আপনি তাকে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাখেন। কিন্তু প্রেমিক হিসেবে তাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসাও আপনার কর্তব্য। সামর্থ্যনুযায়ী তার বৈধ আবদার পুরা করাও আপনার দায়িত্ব। আর স্ত্রীও আপনার সাথে দুই ধরণের সম্পর্ক রাখে। একটি হলো মাহকূমাহ বা অধিনস্থা হিসেবে আর আরেকটি হলো মাহবূবাহ বা ভালোবাসার পাত্রী হিসেবে। তাই তাকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মুহাব্বতের হকও পুরো মাত্রায় আদায় করুণ। তাহলেই দাম্পত্য জীবন সুখময় হবে এবং মহা আল্লাহ পাকও আপনাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন।
আরও পড়তে পারেন : শাসনের মেজাজ পোষণ করবেন না!
লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। বই : আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২
এরপর পড়ুন : মুচকি হাসি ও সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করুন
প্রিয় পাঠক ভাই, আমরা আশা করি স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটাতে লেখকের আত্মশুদ্ধিমূলক মূল্যবান কথাগুলি আপনার ভালো লেগেছে। তাই এটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুল করবেন না।
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.