রাগের মাথায় কসম খাওয়ার বিভ্রাট (তালাকের ছোট গল্প)

মাথায় কসম। কসম খাওয়ার বিভ্রাটস্বামী-স্ত্রী। দু’জনের ছোট্ট পরিবার। সুখেই অতিবাহিত হচ্ছিল তাঁদের দাম্পত্য জীবন। দুঃখের এতটুকু ছোঁয়া লাগেনি এখনো। একে অপরকে ভালোবাসে পাগলের মতো। একজন ছাড়া অন্যজনের জীবন যেনো অর্থহীন, বেকার।

স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র ভালোবাসা শয়তান একদম দেখতে পারে না। সে উভয়ের পিছু নেই। মনোমালিন্য সৃষ্টি ও সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর জন্য কোমর বেঁধে মাঠে নেমে যায়। চেষ্টা চালিয়ে যায় অব্যাহত গতিতে। অবশেষে সে আংশিক সফলও হয়।

একদিন সামান্য একটি ব্যাপার নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মন কষাকষি হয়। শয়তান তাতে ইন্ধন যোগায়। ক্রমে ক্রমে উভয়ের দুরত্ব বাড়তে থাকে। বৃদ্ধি পায় তিক্ততা। সৃষ্টি হয় ভালোবাসার শক্ত প্রাচীরে বড় এক ফাটল।

এই ধারা চলতে থাকে দীর্ঘদিন যাবত। চলতে চলতে এর তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। ধারণ করে ভয়ংকর রূপ। ফলে এক সময় রাগের মাথায় স্বামী বেচারা কসম খেয়ে বলেই বসে—

“আমি যদি তোমার সাথে আগে কথা বলি তাহলে তুমি তালাক।”

স্ত্রীকে আর থামায় কে! সেও সঙ্গে সঙ্গে অভিমান করে বলে

“আর আমি যদি আগে কথা বলি, তাহলে আমার অমুক গোলাম আযাদ।”

দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে যায়। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সংসারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। স্বামী আগে কথা বললে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কথা বলা সে শুরু করতে পারছে না।

অপর দিকে স্ত্রী আগে কথা বললে তার মূল্যবান গোলাম আযাদ হয়ে যাবে। সুতরাং সেও গোলাম হারাতে রাজী নয়।

স্বামী বেচারা রাগের মাথায় কসম খেয়েছিল ঠিক, কিন্তু এখন তার আফসোসের কোনো শেষ নেই। সে সীমাহীন পেরেশানীতে নিপতিত হলো। আলেমদের কাছে দৌড়াল। ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলল, আমাকে এমন একটা পন্থা বের করে দিন, যাতে কথাও বলা হয়, তালাকও না হয়।

আলেমগণ সবাই এক বাক্যে বলে দিলেন, স্ত্রীর সাথে আগে কথা বললে নিশ্চিত তালাক হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তালাক থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনিভাবে স্ত্রী আগে কথা বললে গোলাম আযাদ হয়ে যাবে—এ থেকেও বাঁচার কোনো উপায় নেই। সুতরাং হয় স্ত্রী তালাক, না হয় গোলাম আযাদ—এ দুই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। দুটির যে কোনো একটি গ্রহণ করতেই হবে।

আলেমদের এই বক্তব্য শুনে লোকটির পেরেশানী আরো বেড়ে গেল। অবশেষে তার মনে পড়ে গেল ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর কথা। সুতরাং কাল বিলম্ব না করে সে দ্রুত হাজির হলো তার কাছে। অতঃপর খুলে বলল সবকিছু।

ইমাম আবু হানিফা রহঃ বিস্তারিত বিবরণ শুনে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন—

“যাও, স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলো। কোনো ভয় নেই। তালাক হবে না।”

এ কথা শুনে সকল আলেম বিস্ময়ে ফেটে পড়লেন। সবাই বলতে লাগলেন, ইমাম সাহেবকে আমরা সর্বোচ্চ জ্ঞানী ভাবতাম। তাঁকে মর্যাদা দিতাম সকল আলেমের উপরে। অথচ তিনি কিভাবে এই নীতিজ্ঞানহীন ফতোয়া দিলেন! শর্তযুক্ত তালাকের ক্ষেত্রে শর্ত পাওয়া গেলেও কিভাবে তালাক হয় না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

আলেমগণ সবাই ইমাম সাহেবের দরবারে সমেবেত হলেন। অতঃপর এরূপ ফতোয়া তিনি কিভাবে দিলেন তার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন।

জবাবে ইমাম সাহেব বললেন, স্বামীর কসম খাওয়ার পরপরই  স্ত্রী তাঁকে সম্বোধন করে কসম খাওয়াতে স্ত্রীর কথা বলা হয়ে গেছে। সুতরাং এখন যদি স্বামী কথা বলে তাহলে তা হবে স্ত্রীর পরে কথা বলা। আর সে কসম খেয়েছে, স্ত্রীর আগে কথা বললে সে তালাক। এখন যেহেতু স্ত্রীর আগে কথা বলা হচ্ছে না, সেহেতু তালাক হওয়ারও কোনো অবকাশ থাকে না। অনুরূপভাবে স্বামী কথা বলার পর স্ত্রী কথা বললে তার গোলামও আযাদ হবে না।

ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর এই জ্ঞানের গভীরতায় সবাই তলিয়ে গেলেন। তাঁদের মুখ থেকে আর কোনো কথা শোনা গেল না। সেই সাথে শয়তানও চূড়ান্ত সফলতায় পৌঁছতে পারল না।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! সংসার জীবনের ছোট বড় নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাঝে মধ্যে স্বামী-স্ত্রীতে মান-অভিমান হতেই পারে, হতেই পারে মনোমালিন্য। কিন্তু তাই বলে ধৈর্যহারা হয়ে তালাকের পর্যায়ে চলে যাওয়া মোটেও সমীচিন নয়। তাই রাগের মাথায় কসম খাওয়া ও তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে যেমন সতর্কতায় সাথে সবর করতে হবে; সচেষ্ট হতে হবে স্বামীকে খুশি করার, উদ্যোগ নিতে হবে স্বামীর মনের যাবতীয় কষ্ট দূর করার, তেমনি স্বামীকেও প্রদর্শন করতে হবে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা। স্ত্রীর অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য তাকেও অবলম্বন করতে হবে—নানাবিধ কলা-কৌশল। নইলে সংসারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে বেশিদিন লাগবে না। উল্লেখ যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহর ভয় থাকলে, ভালোবাসা থাকলে, একে অপরের হক আদায়ের ব্যাপারে আন্তরিক হলে—মান-অভিমান কীভাবে ভাঙ্গতে হবে, কীভাবে তাঁকে করতে হবে—তা আমাকে কেন, দুনিয়ার কাউকেই বলে দিতে হবে না।

স্বামী-স্ত্রীর নিজের সামনেই তখন অভিমান ভাঙ্গানোর আজীব আজীব কৌশল উপস্থিত হবে। ব্যাস, সেই কৌশলটিই তখন প্রয়োগ করুণ। দেখবেন, কেল্লা ফতেহ। বিজয় আপনার হাতের মুঠোয়। তখন মনে হবে—এই মান-অভিমানের দ্বারা সম্পর্কের আরো উন্নতি হয়েছে। ভালোবাসা আরো গভীর হয়েছে। আন্তরিকতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সুখময় দাম্পত্য জীবন নসীব করুণ। দীন-দুনিয়ার সকল কাজে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সহযোগী হোক—মহান আল্লাহর কাছে এ আমার ঐকান্তিক কামনা। হে আল্লাহ! তুমি আমার এ দোয়া কবুল করো। বিশেষ করে হৃদয় গলে সিরিজের প্রতিটি পাঠক-পাঠিকাকে এই মহাদৌলত নসীব করো। আমীন।

[সূত্রঃ আল ইফাযাতুল ইয়াওমিয়্যাহ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৩৫]   

লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। 

এরপর পড়ুন : হৃদয়ের টান

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading