মদখোর প্রতিবেশিটা ছিল বয়সে যুবক। নেশাগ্রস্থ হয়ে সে বারবার একটি কবিতা পাঠ করত। এই কবিতাটি সে এতো বেশি পাঠ করত যে, উপস্থিত লোকজন শুনে শুনে তা মুখস্থ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। কবিতাটির মর্ম হলো—
‘মানুষ আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা এমন এক যুবককে ধ্বংস করেছে, যে যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে সীমান্ত হেফাজত করতে পারতো।’
ইমাম আবু হানিফা রহঃ তাকে অনেক বুঝিয়েছেন। সমঝিয়েছেন। মদ্যপানের অভ্যাস পরিত্যাজ্ঞ করতে বলেছেন। অনুরোধ করেছেন, রাত্রিকালে হৈচৈ না করতে। কিন্তু যুবক তাতে কর্ণপাত করেনি। ভ্রূক্ষেপ করেনি মোটেও। সে রয়ে যায় আগের মতোই।
যুবকের এই নিকৃষ্ট কর্মের জন্য এলাকার লোকজন অস্বস্থি বোধ করতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে এই যুবককে তারা ঘৃণা করতে শুরু করে। সেই সাথে তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়। রাগান্বিত হয়।
ইতোপূর্বে এলাকার লোকজনও তাকে এসব অন্যায়কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য বারণ করেছে বহুবার। বাধা দিয়েছে বারবার। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তারা ঐ যুবকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে।
রাতে পুলিশ এল। তারা যুবককে গ্রেফতার করে কয়েদখানায় নিয়ে বন্দী করে রাখল।
সে রাতে ইমাম আবু হানিফা রহঃ শোরগোল শুনতে পেলেন না। তাই তিনি এই যুবক সম্পর্কে লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, ঐ যুবকের বাড়ি আজ নীরব কেন? সে কি তাঁর বাড়িতে নেই?
লোকেরা বলল, এলাকার লোকজন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাই পুলিশ তাকে পাকড়াও করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
মুচি যুবকের গ্রেফতারের সংবাদে হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ দারুণ ব্যথিত হলেন। তিনি নিজের মর্যাদা ও পজিশনের দিক বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে কয়েকজন সঙ্গীসহ আদালতে ছুটে গেলেন।
হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ-এর আগমনে গোটা আদালত প্রাঙ্গনে সাড়া পড়ে গেল। মহামান্য হাকিম সাহেব স্বীয় এজলাস ছেড়ে নেমে এলেন। ইমাম সাহেবকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করলেন। তারপর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—হযরত! হঠাৎ করে আপনার আগমন? এ তো আপনার সম্পূর্ণ নীতি বিরোধী কাজ!
হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ বললেন আমার এক প্রতিবেশি। পেশাউ মুচি। মদপানের অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। পাঠিয়ে দিয়েছে কয়েদখানায়। আমি তা জন্যেই এসেছি। আপনি তাকে আমার জিম্মায় জামিন দিন। বাকিটা আমি দেখব। পরবর্তীতে সে এরূপ করলে আমি এর জন্য দায়ী থাকব।
হাকিম সাহেব কোনো আপত্তি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে মদখোর যুবকের জামিন মঞ্জুর করে দিলেন।
যুবক জেল থেকে বেরিয়ে এল। মুক্তির আনন্দে সে আত্মহারা। আবু হানিফা রহঃ তাঁর হাত ধরলেন। বললেন, কী ভাই! আমি তো তোমাকে ধ্বংস হতে দেই নি।
এ কথা দ্বারা হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ যুবকের সেই প্রসিদ্ধ কবিতার প্রতি ইঙ্গিত করলেন।
যুবক মুচি এতক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। সে যখন বুঝল, হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ-এর দয়া, অনুকম্পা আর সুপারিশেই সে মুক্তি পেয়েছে, অথচ সে তাকে কত জ্বালাতন করেছে, তখন সে দারুণ প্রভাবান্বিত হলো এবং অত্যন্ত আদব ও নম্রতার সাথে বলল, হে আমার মনিব! আজকের পর আপনি আমাকে এমন কোনো কাজ করতে দেখবেন না। যাতে আপনি কষ্ট পান।
এরপর থেকে সত্যি সত্যি সেই যুবক হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর দরসে উপস্থিত হতে লাগল। খোদার কী অপূর্ব মহিমা! হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ-এর ওসিলায় একদিন সে কূফার বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে পরিগনিত হলো।
প্রিয় পাঠক! তাই আসুন, আমরাও মানুষের সাথে হযরত ইমাম আবু হানিফা রহঃ-এর ন্যায় চরিত্র মাধুরীর অনুপম দৃষ্টান্ত পেশ করি। পাপী-তাপী লোকদেরকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে না দিয়ে তাদেরকে ভালোবেসে আপন করার চেষ্টা করি। তাঁর সাথে উত্তম আচরণ করি। ত্যাগের সর্বোত্তম নমুনা পেশ করি। তাহলে একদিন দেখন, সেই মানুষগুলো তাদের যাবতীয় অপরাধ কার্য পরিত্যাগ করেছে। পরিচালনা করতে শুরু করেছে ইসলামী বিধান অনুযায়ী নিজের জীবনকে। সেই সাথে তারা পরিণত হয়েছে আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধুতে। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম
[সহায়তায়ঃ জীবনের পাতা থেকে, পৃষ্ঠাঃ ৪৫]
আরও পড়ুনঃ যুবতির কবলে যুবক
Please join our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Tumblr And Youtube channel.