তিরস্কার করে আর কী লাভ, যা হওয়ার হয়ে গেছে।

তিরস্কার করা অর্থ কাউকে নিন্দা, ভর্ৎসনা বা দোষারূপ করাকে বুঝানো হয়। কাউকে তিরস্কার করা, উপদেশ কিংবা পরামর্শ দেওয়ার পূর্বে সম্মানিত লেখকের এই কথা গুলো পড়ুন। আশা করি আপনার ব্যক্তি জীবনে লেখেকের কথাগুলো কাজে আসবে।

তিরস্কার করে আর কী লাভ, যা হওয়ার হয়ে গেছে।

তিরস্কার

অনেকে মনে করে, যে ভুল-ক্রটি সাধারণত কারাে চোখে পড়ে না সে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিলে বা এ কারণে তাকে তিরস্কার করলে তার নৈকট্যশীল হওয়া যায় এবং এর মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হয়। আসল কথা হলাে, তিরস্কার করা কখনও বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। তিরস্কার করা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকাই উচিত। এর পরিবর্তে এমনভাবে সংশােধনের চেষ্টা করা উচিত যা কারাে জন্য কষ্টদায়ক কিংবা ব্রিতকর নয়। এমনভাবে যে আপনিও কষ্ট পাবেন না এবং আপনার দ্বারাও যেন কষ্ট না পায়।

কখনাে কখনাে এমন অনেক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় যে, দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হয়। বিশেষত জাগতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলাের ক্ষেত্রে এমন বেশি করতে হয়। কবি বলেন—

নির্বোধরা কখনাে কোনাে জাতির নেতা হতে পারে না। কিন্তু নেতাকে কখনাে কখনাে নির্বোধের ভান করতে হয়।

মনে রাখতে হবে, তিরস্কৃত ব্যক্তি তিরস্কারকে তার দিকে তাক করে রাখা ধারালাে তীর বলে বিবেচনা করে থাকে। কেননা, তিরস্কারকে সে নিজের ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। এটি হলাে প্রথম লক্ষণীয় বিষয়। দ্বিতীয় আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলাে, যথাসম্ভব জনসম্মুখে কাউকে কখনাে কোনাে উপদেশ দেবেন না। কবি বলেন

লােকচক্ষুর অন্তরালে যত খুশি উপদেশ দাও, কিন্তু সবার সামনে এ কাজ কখনাে কর না। লােকসমাজে উপদেশ এক ধরনের তিরস্কার। আমি তােমার কাছে এটা কখনাে শুনতে চাই না।

তবে, একই ভুল যদি ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখা যায় এবং সতর্ক করার প্রয়ােজন হয় তাহলে সেখানে রাসূল (সাঃ) এর নীতি অবলম্বন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাসূল সাঃ বলতেন: ‘লােকদের কী হলাে, যে, তারা এধরনের কাজ করে। এধরনের তিরস্কার চাবুকের ন্যায় কাজ করে।

অনেকে বেশি বেশি তিরস্কার করে অন্যদেরকে দূরে ঠেলে দেয়। আবার অনেক সময় এমন বিষয়ে তিরস্কার করা হয়, যার কোনাে প্রয়ােজন নেই। এক্ষেত্রে তিরস্কার কোনাে কাজেই আসে না।

জনৈক গরিব লােক পরিবার-পরিজন ফেলে বিদেশে পাড়ি জমাল। সেখানে সে ট্রাকের ড্রাইভিং পেশায় নিয়ােজিত হলাে। একদিন সে খুব ক্লান্ত ছিল। ক্লান্তি নিয়েই দূরের কোনাে এক শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাে।

তন্দ্রাভাব থাকায় সে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌছার জন্য দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে লাগল। ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে সিগনাল না দিয়েই সে সামনের একটি গাড়িকে ওভারটেক করলাে। পরক্ষণেই দেখলাে তার সামনে ছােট্ট আরেকটি গাড়ি। গাড়িটিতে তিনজন যাত্রী। ট্রাকচালক ছোট্ট গাড়িটিকে রক্ষা করতে অনেক চেষ্টা করলাে। কিন্তু পারল না। একেবারে মুখােমুখি সংঘর্ষ হলাে।পথচারীরা ঘটনাটি দেখতে লাগল।

ট্রাকচালক নিচে নামল। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়িটি ও গাড়ির যাত্রীদের দিকে তাকাল। কেউ জীবিত নেই। লােকজন গাড়ি থেকে লাশ বের করে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেছে।

ট্রাকচালকও বসে বসে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সে এর পরিণতি ভাবতে লাগল। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠল যন্ত্রণাদায়ক কারাভােগ ও রক্তপণের কথা। কী হবে তার স্ত্রী ও ছােট ছােট সন্তানদের ভবিষ্যৎ। সে এখন অসহায়। তার মাথায় দুশ্চিন্তার পাহাড় চেপে বসেছে।

এদিকে পথচারীরা তার পাশ দিয়ে যাচ্ছে আর তাকে তিরস্কার করছে। আশ্চর্য! এটা কি তিরস্কারের সময়? তারা একটুও সংযম অবলম্বন করতে পারলাে না? কিছুক্ষণ কি দেরি করা যেতাে না? একজন বললাে, এত দ্রুত গাড়ি চালাও কেন? এবার মজা বােঝ।

আরেকজন বললাে, “আমি নিশ্চিত তুমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলে। তারপরও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছ। গাড়ি থামিয়ে ঘুমিয়ে নিলে না কেন?” তৃতীয়জন বললাে, “তােমার মতাে ব্যক্তিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স না দেয়াই উচিত”।

লােকেরা এ ধরনের আরাে অনেক কথা তিরস্কারের স্বরে বলতে লাগল। লােকটি হতভম্ব নির্বাক হয়ে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে একটি পাথরের ওপর বসে থাকল। হঠাৎ সে একদিকে ঢলে পড়ল। এরপর তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল।

তিরস্কারকারীদের তিরস্কারের আঘাতে সে মারা গেল। তারা যদি ধৈর্যধারণ করে একটু সংযম অলম্বন করত, তাহলে একটি প্রাণ বেঁচে যেত এবং সবার জন্যই মঙ্গলজনক হতাে।

নিজেকে তিরস্কৃতের স্থানে রেখে চিন্তা করুন। বিষয়টি তার দৃষ্টি দিয়ে দেখুন। তার জায়গায় হলে হয়তাে আপনি এর চেয়েও বড় কোনাে ভুল করে ফেলতেন।

রাসূল (সাঃ) এসব বিষয়ে খুব খেয়াল রাখতেন। রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কিরাম খায়বার যুদ্ধ থেকে মদিনায় ফিরে আসছেন। দীর্ঘ সফরের কারণে সবাই ক্লান্ত ও শান্ত। চলতে চলতে রাত হয়ে গেল। বিশ্রামের জন্য রাস্তার কাছেই এক জায়গায় কাফেলা যাত্রাবিরতি করলাে। রাসূল (সাঃ) ঘােষণা করলেন, “আমরা তাে ক্লান্ত”। ঘুমিয়ে পড়লে ফজরের সময় উঠতে সমস্যা হতে পারে। অতএব, কে ফজর পর্যন্ত জাগ্রত থেকে আমাদেরকে জাগিয়ে দেবে?

বেলাল (রাঃ) ছিলেন খুব উদ্যমী। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এ দায়িত্ব পালন করব।

রাসূল (সাঃ) ও সাহাবিগণ সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে বেলাল (রাঃ) নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। দীর্ঘ সফরের কারণে তিনিও ক্লান্ত ছিলেন। নামায পড়তে পড়তে একপর্যায়ে তিনি আরাে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। ফলে একটু বিশ্রামের জন্য পূর্বমুখী হয়ে উটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে সুবহে সাদিকের অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু একসময় নিজের অজান্তেই তিনিও ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকলেই ছিলেন ক্লান্ত ও শ্রান্ত। তাই সবাই খুব গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। রাত শেষ হলাে। সুবহে সাদিক হলাে। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। অবশেষে সূর্যের প্রখর তাপে তাদের ঘুম ভাঙল।

সর্বপ্রথম রাসূল (সাঃ) জাগলেন। তিনি কাফেলার সবাইকে জাগালেন। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে সূর্য দেখে সবাই অস্থির হয়ে পড়লেন। সবার দৃষ্টি বেলালের দিকে।

রাসূল (সাঃ) বেলাল (রাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেলাল! তুমি এটা কী করলে? বেলাল (রাঃ) খুব সংক্ষেপে উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল! আপনার যা হয়েছিল আমারও তা হয়েছিল।

আমিও মানুষ। চেষ্টা করেও আমি ঘুম রােধ করতে পারি নি। আপনাদের মতাে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

রাসূল (সাঃ) বললেন, “তুমি সত্য বলেছ। রাসূল এ ব্যাপারে আর কিছু বললেন না। এক্ষেত্রে তিরস্কার করে লাভ আর কী হবে?

সাহাবিদের অস্থিরতা দেখে রাসূল (সাঃ) সবাইকে সে স্থান ত্যাগ করতে বললেন। কাফেলা যাত্রা শুরু করলাে। একটু সামনে গিয়ে থামলেন। তারপর কাফেলার সবাইকে নিয়ে অযু করলেন। ফজরের কাজা নামায আদায় করলেন। সালাম ফিরিয়ে সাহাবিদেরকে বললেনঃ

من تبين الصلاة فليصلها اذا ذكرها.

অর্থ : নামায আদায় করতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্র তা আদায় করে নেবে। (সহিহ মুসলিম: ১০৯৭)

আল্লাহু আকবার! কী চমৎকার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা! কী সুন্দর সিদ্ধান্ত ! আল্লাহর রাসূল ছিলেন সবার জন্য আদর্শ। তিনি এখনকার সেসব নেতাদের মতাে ছিলেন না যারা অধীনস্থদের ওপর সবসময় তিরস্কার ও ভৎসনার লাঠি ঘুরান। তিনি নিজেকে অধীনস্থদের স্থানে রেখে তাদের দৃষ্টিতে দেখতেন। মানুষের দেহ নয়; বরং হৃদয়ের সাথে তিনি লেনদেন করতেন তিনি বিশ্বাস করতেন- এরা মানুষ, মেশিন নয়।

অষ্টম হিজরি সনের কথা। রােমানরা সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে শামের দিক থেকে অগ্রসর হলাে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, রাসূল (সাঃ) যুদ্ধের জন্য আগেই সৈন্য প্রস্তুত করেছিলেন।

রাসূল (সা:) ও রােমানদের উদ্দেশ্যে সৈন্য প্রেরণের প্রস্তুতি শুরু করলেন। সাহাবিদেরকে যুদ্ধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। তিন হাজার সাহাবিকে যুদ্ধের যাবতীয় সরঞ্জামাদি ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রস্তুত করলেন।

রাসূল বলে দিলেন, “তােমাদের সেনাপতি হলাে যায়েদ বিন হারেসা। যায়েদ শহিদ হলে সেনাপতি হবে জাফর বিন আবু তালেব। জাফরও যদি শহিদ হয় তাহলে সেনাপতি হবে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা।

রাসূল (সাঃ) মুজাহিদ কাফেলাকে বিদায় দেয়ার জন্য বের হলেন। সঙ্গে অন্যরাও বের হলাে। সবাই সৈন্যবাহিনীকে বিদায় দিল। বিদায়ের কালে তারা বললাে–

صحبه الله , ودفع عنه , ورد گم إلينا ضايجين.

অর্থঃ আল্লাহ তােমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি তােমাদের রক্ষা করুন । তােমাদেরকে নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনুন।

আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) শাহাদতের জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তিনি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন–

হে রহমান আল্লাহ, আমি তােমার কাছে ক্ষমা চাই, আমি আরাে চাই একটি বর্শা যেন আঘাত করে আমার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় যেন লােকজন ঈর্ষা করে বলে ওঠে: হে আল্লাহর পথের মুজাহিদ তুমি সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছ।

এরপর মুসলিম বাহিনী মুতার দিকে রওয়ানা হলাে। পথিমধ্যে তারা শামের মাআন নামক স্থানে ছাউনি ফেললাে। এখানে পৌঁছে মুসলমানরা জানতে পারল, বালকা নামক স্থানে রােমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক লাখ নিয়মিত রােমান সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছে। তার সঙ্গে বিভিন্ন গােত্রের আরাে একলাখ সৈন্য রয়েছে। এর ফলে রােমান সৈন্যদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখে।

মুসলমানরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে মাআনে দুইরাত অবস্থান করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। এ বিষয়ে সাহাবিদের মধ্যে অনেক আলােচনা-পর্যালােচনা হলাে। কেউ কেউ বললেন, “আমরা রাসূল (সাঃ) এর কাছে চিঠি পাঠিয়ে শত্রুবাহিনীর সমরশক্তি সম্পর্কে অবহিত করি। এতে রাসূল হয় অতিরিক্ত সৈন্য পাঠিয়ে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন, অথবা তিনি যা ভালাে মনে করবেন সে অনুযায়ী আদেশ দেবেন। আমরা সে আদেশ পালন করব।’ এ ব্যাপারে অনেক কথা হলাে।

এসব কথা শুনে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা দাড়িয়ে উচ্চ আওয়াজে বললেন, ‘হে মুজাহিদগণ! আল্লাহর কসম! আজ তােমরা যা অপছন্দ করছ, তা লাভ করার জন্যই তাে তােমরা বেরিয়েছিলে! আল্লাহর পথে শাহাদাত লাভের সৌভাগ্য থেকে তােমরা পিছপা হচ্ছ ।! মনে রেখ! আমরা জনবল, সামরিক শক্তি বা অস্ত্রশস্ত্রের ওপর নির্ভর করে দুশমনের মােকাবিলায় আসি নি। মুসলমান কখনাে অস্ত্রের ওপর ভরসা করে যুদ্ধ করে না। আমরা তাে সে দ্বীন আর ঈমানের শক্তি নিয়ে শত্রুর মােকাবিলায় এসেছি, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। অতএব সামনে চল। বিজয় বা শাহাদত- যাই আমাদের লাভ হােক তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর।

আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ)-এর ঈমানদীপ্ত ভাষণে সবাই যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। তারা নব উদ্যমে সামনে এগােতে লাগলেন। অবশেষে তারা মুতা নামকস্থানে রােমানদের বিশাল বাহিনীর মুখােমুখি হলেন।

আবু হােরায়রা (রাঃ) বলেন, “আমি মুতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মুশরিকরা যখন আমাদের কাছাকাছি এলাে, তখন তাদের একেকজনের সঙ্গে এতাে বিপুল পরিমাণ ঢাল তরবারি, অস্ত্র সরঞ্জাম, রেশম, স্বর্ণ ইত্যাদি দেখলাম যা এর আগে কোনাে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায় নি। এসব দেখে আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। তখন সাবেত বিন আরকাম (রাঃ) আমাকে বললেন, ‘আবু হােরায়রা! তুমি মনে হয় বিশাল সৈন্যসমাবেশ দেখছ?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

তিনি বললেন, তুমি বদরে আমাদের সঙ্গে ছিলে না। সেখানে আমরা সংখ্যার বলে বিজয় লাভ করি নি।

এরপর সাহাবিরা শত্রুর মুখােমুখি হলেন। যুদ্ধ শুরু হলাে। যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর দেয়া পতাকা বহন করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। বর্শার আঘাতে আঘাতে তার পুরাে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং শাহাদাতের অমীয় সূধা পান করলেন।

এরপর জাফর (রাঃ) পূর্ণ সাহসিকতার সঙ্গে পতাকা তুলে নিলেন। তিনি ঝাকড়া চুলের ঘােড়ার পিঠে চড়ে শত্রুর মােকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার মুখে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল বিশেষ কবিতামালা–

কী সুখ জান্নাতে, কী চমৎকার জান্নাতের দৃশ্য! এর শরাবে রয়েছে কী ঘ্রাণ আর শীতল পরশ।

আর রােমানদের চরম শাস্তি এ তাে কাছে চলে এসেছে। তাদের বংশ নির্বংশ হবে । নিঃশেষ হবে তাদের সব আশা-ভরসা। ময়দানে যখন নেমেছে তখন তাদের কাউকে ছাড়ব না।

জাফর (রাঃ) ডান হাতে পতাকা বহন করছিলেন। শক্রর আঘাতে তার ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর তিনি বাম হাতে পতাকা তুলে নিলেন। তাও বাহু পর্যন্ত কেটে গেল। তখন দুই বাহুর অবশিষ্ট অংশ দিয়ে পতাকা আকড়ে ধরলেন। এভাবে লড়াই করতে করতে তিনিও শাহাদাতের অমীয় সূধা পানে ধন্য হলেন। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র তেত্রিশ বছর।

আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, “আমি সেদিন জাফর (রাঃ)-এর কাছেই ছিলাম। তার শাহাদাতের পর আমি গুণে দেখলাম, তার শরীরে পঞ্চাশটির মতাে তীর তরবারির জখম ছিল। এসব আঘাতের একটিও তার পেছন দিকে ছিল না। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা জান্নাতে তাকে দুটি ডানা দান করেছেন। এ ডানা দিয়ে তিনি জান্নাতে যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ান।

জাফর (রাঃ) শহিদ হয়ে গেলে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা তুলে নিলেন। ঘােড়ার পিঠে চড়ে পতাকা হাতে সামনে এগুতে থাকলেন। তিনি হয়তাে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছিলেন। তাই নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে বারবার আবৃত্তি করতে লাগলেন–

শপথ করেছি আমি হে আমার মন, নামতে হবে তােমাকে ঘােড়া ছেড়ে যদিও তােমার তা ভালাে না লাগে।

দেখ কাফেরদের ঢাল-তলােয়ার কেমন ঝনঝন করে বাজে দেখ চতুর্দিকে তারা কেমন ঘােড়া হাকিয়ে ছুটছে। তুমি কি জান্নাতের বাগ-বাগিচায় বিনােদন করতে চাও না?

এরপর তিনি যায়েদ ও জাফরকে স্মরণ করে বললেন–

হে আমার মন এখানে না মরলেও একদিন তােমাকে মরতে হবে। এ যে মৃত্যুর অঙ্গনে তুমি পৌছেছ। এখানে তুমি যা চাইবে তাই পাইবে। তুমি যদি তােমার পূর্ববর্তী (জায়েদ ও জাফর)দের মতাে কাজ করতে পার তাহলে তুমি সফল হয়ে যাবে।

এরপর তিনি ঘােড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লেন। এদিকে তার এক চাচাত ভাই গােশতযুক্ত একটি হাড় নিয়ে এসে বললাে, এটা খেয়ে কোমরটা একটু সােজা কর। এ কয়দিন তােমার ওপর দিয়ে যে ধকল গেছে তা আর কী বলব।

আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) তার হাত থেকে হাড়টা নিয়ে তাতে একটা কামড় দিলেন। ইতােমধ্যে রণাঙ্গনের এক কোণে শােরগােল শুনতে পেয়ে তিনি হাড়টার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘লােকজন জীবনবাজি রেখে লড়ছে আর তুমি এখনাে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত?’ এ কথা বলে তিনি তা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এরপর তরবারি হাতে সেদিকে ছুটলেন এবং লড়াই করতে করতে তিনিও শহিদ হয়ে গেলেন। 

মুসলিম বাহিনীর পতাকা মাটিতে পড়ে গেল। মুসলিম বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। কাফের বাহিনী নবােদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পতাকাটি ঘােড়ার পায়ের তলে দলিত হলাে, ধূলােয় ধূসরিত হলাে।

বীরযােদ্ধা সাবেত বিন আরকাম (রাঃ) অগ্রসর হয়ে পতাকাটি হাতে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, “হে মুসলিম বাহিনী! এ দেখ তােমাদের পতাকা। তােমাদের মধ্য থেকে কাউকে পতাকাবাহক আমির হিসেবে নির্বাচন কর।

যারা তার কথা শুনল তারা সবাই বলে উঠল, ‘তুমিই গ্রহণ কর। তুমিই গ্রহণ কর।’

তিনি বললেন, ‘আমি পারব না।’

এরপর সবাই খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-কে নির্বাচন করলেন। তিনি পতাকা হাতে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরে এক সময় তিনি বলেছিলেন, ‘মুতার যুদ্ধে আমার হাতে নয়টি তরবারি ভেঙ্গেছে। যুদ্ধ শেষে আমার কাছে শুধু একটি ইয়েমেনি তরবারি ছিল।

যাই হােক, একপর্যায়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) তার বাহিনী নিয়ে কৌশলে পেছনে সরে আসলেন । রােমানরাও তাদের ছাউনিতে ফিরে গেল । খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) সেনাবাহিনী নিয়ে রাতেই মদিনায় ফিরে আসা নিরাপদ মনে করলেন না। কেননা, এতে রােমান সৈন্যরা তাদের পশ্চাদ্ধান করতে পারে। এটা ভেবে তিনি যাত্রা স্থগিত রাখলেন। সকালবেলা খালিদ (রাঃ) সেনাবাহিনীর বিন্যাস পরিবর্তন করলেন। অগ্রভাগকে পশ্চাদভাগে আর পশ্চাদভাগকে অগ্রভাগে মােতায়েন করলেন। ডানদিকের বাহিনীকে বামদিকে এবং বামদিকের বাহিনীকে ডানদিকে মােতায়েন করলেন।

যুদ্ধ আবার শুরু হলাে। রােমানরা অগ্রসর হলাে। তাদের বিন্যাস আগের মতােই ছিল। তারা মুসলমান বাহিনীতে নতুন নতুন পতাকা ও নতুন নতুন চেহারা দেখতে পেল। তখন রােমানরা ভাবল, রাতে মুসলমানদের সাহাযকারী সৈন্য এসেছে এখন আর তাদের সাথে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। মুসলমানরা তাদের ওপর নব উদ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণ করলাে। রােমানদের প্রচুর সৈন্য হতাহত হলাে । মুসলমানদের কেবল বারােজন শহীদ হলেন ।

খালিদ (রাঃ) দিন শেষে বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এলেন। এরপর মদিনার উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন। মদিনার কাছাকাছি এলে মদিনার বালকেরা তাদের কাছে ছুটে এলাে। মহিলারাও ঘর থেকে বেরিয়ে এলাে। তারা সবাই কাফেলার দিকে মাটি ছুড়তে লাগল আর বলতে লাগল, হে পলায়নকারীরা! তােমরা আল্লাহর পথ ছেড়ে পালিয়ে এসেছ।’

রাসূল (সাঃ) কাফেলা থেকে সবকিছু শুনলেন। তিনি অনুভব করলেন, তাদের সামনে এ ছাড়া আর কোনাে পথ ছিল না। তাদের যতটুকু ক্ষমতা ছিল, তারা তা করেছে। রাসূল (সাঃ) কাফেলার পক্ষ থেকে জবাব দিলেন

ليشوا بالفار وللجهه الكرار إن شاء الله تعالى

অর্থঃ তারা পলায়ন করে নি; বরং পুনরায় হামলার উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন করে ফিরে এসেছে।

বিষয়টি এভাবে শেষ হয়ে গেল। তারা বীর বাহাদুর। তারা চেষ্টায় কোনাে ত্রুটি করে নি। তারাও তাে মানুষ। এক্ষেত্রে বিষয়টি তাদের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। এখন কাজ হলাে শহীদদের জানাযা পড়া। গাজীদেরকে তিরস্কার করে কোনাে লাভ নেই।

এটাই ছিল রাসূল (সাঃ) এর সবসময়ের নীতি।

মক্কার কাফেররা যখন শুনতে পেল রাসূল (সাঃ) তার সাহাবিদের নিয়ে মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে আসছেন তখন তাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। রাসূল (সাঃ) তাদের কাছে একজন লােক পাঠালেন। সে ঘােষণা করলাে–

‘যে ব্যক্তি নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, সে নিরাপদ। যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ।’

মক্কার কাফেররা ভয়ে পালাতে লাগল। ওদিকে কোরাইশের কিছু অশ্বারােহী যুবক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সমবেত হলাে। কিন্তু তাদের গােত্রের লােকজন তাদেরকে সমর্থন করতে বা তাদেরকে সহযােগিতা করতে অস্বীকার করলাে। অবশেষে খান্দামা নামক স্থানে তাদের একটি দল সমবেত হলাে। এ দলে ছিল সাফওয়ান বিন উমাইয়া, ইকরিমা বিন আবু জাহল ও সুহাইল বিন আমর । তারা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে আরাে কিছু লােক একত্র করলাে। মক্কার কাফের হামাস বিন কায়স রাসূলের আগমনের আগ থেকেই অস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছিল।

একদিন তার স্ত্রী তাকে বললাে, এগুলাে কেন প্রস্তুত করছ? সে বললাে, মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য।

তার স্ত্রী মুসলমানদের শৌর্য-বীর্যের কথা জানত। সে বললাে, “আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সামনে দাঁড়াতে পারবে, এমন কাউকে তাে আমি দেখি না।

হামাস বললাে, আল্লাহর শপথ! আমি আশা করছি তাদের (মুসলমানদের) কাউকে বন্দী করে নিয়ে এসে তাকে গােলাম হিসেবে আমি তােমার সামনে পেশ করবাে।

এরপর সে অহঙ্কার করে বলতে লাগল–

তারা যদি আসে তাহলে আমি বসে থাকব না। এ যে আমার আছে পরিপূর্ণ অস্ত্র-শস্ত্র । আরাে আছে দুধারি ও দ্রুত হামলাকারী তলােয়ার।

এরপর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে খান্দামার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাে। সেখানে তার সঙ্গীরাও ছিল। সে ওখানে পৌঁছতেই মুসলমানরা তাদের মুখােমুখি হলাে। মুসলমানরা তাদের ওপর হামলা করলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে বারাে তেরােজনেরও বেশি কাফেরকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিলেন।

হামাস বিন কায়স এ অবস্থা দেখে সাফওয়ান ও ইকরামার দিকে তাকাল। দেখলাে, তারা বাড়ির দিকে পালাচ্ছে। সেও বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে চিৎকার করে স্ত্রীকে বললাে, তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ কর। তারা ঘােষণা করেছে, ‘যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, সে নিরাপদ।

স্ত্রী বললাে, তুমি যা বলেছিলে, তা গেল কোথায়? তাদেরকে বন্দী করবে! তাদেরকে গােলাম বানিয়ে আমাকে উপহার দেবে।

হামাস তখন বললো, খান্দামার যুদ্ধে তুমি যদি যেতে ! তাহলে দেখতে, ইকরিমা আর সাফওয়ান পালাচ্ছে, আবূ ইয়াযিদ হতভম্ব হয়ে স্তম্ভের মতাে দাঁড়িয়ে আছে, মুসলমানদের তরবারিগুলাে তাদেরকে ধাওয়া করছে। কাটছে তারা বাহু আর মাথার খুলি সেখানে মৃত্যুর ভয়াবহ প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে না। ক্ষুধার্ত সিংহগুলাে যখন আমাদের তাড়া করছিল। (তখন তুমি যদি সেখানে থাকতে) তাহলে ভর্ৎসনা করে আমাকে একটি শব্দও বলতে না।

বাস্তবতাও তাই। তার স্ত্রী যদি খান্দামা যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করত তাহলে স্বামীকে তিরস্কার করে সে একটি শব্দও বলতে পারত না।

ওদিকে রাসূল (সাঃ) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনি মক্কার সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে পুরােপুরি অবগত ছিলেন। তাই যতটুকু না করলেই নয় ততটুকু যুদ্ধ করলেন। এরপর বললেন–

إن هذا البلد كرمه الله يوم خلق الوات والأرض فهو حرام بزمة الله إلى يوم القيامة واه كم يحل القتال فيه خير قبل ولم يحل إن إلا ساعة من نهار قهو.

‘আল্লাহ আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন থেকে এ শহরকে সম্মানিত করেছেন, অর্থাৎ এ শহরে যুদ্ধবিগ্রহ হারাম করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত তা সম্মানিত থাকবে। আমার আগে কারাে জন্য এতে রক্তপাত বৈধ করা হয় নি। তবে আজকের দিনের কিছু সময়ের জন্য আমাকে আল্লাহ তাআলা এর বৈধতা দিয়েছেন। (সহিহ বুখারী:২৯৫১, সহীত মুসলিম: ২৪১২)

রাসূল (সাঃ)-কে জানানাে হলাে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদ তার অশ্বারােহী বাহিনী নিয়ে মুশরিকদের যাকে পাচ্ছে, তাকেই হত্যা করছে।’

রাসূল (সাঃ) জনৈক সাহাবিকে বললেন, ‘যাও। খালিদ বিন ওয়ালিদকে গিয়ে বল, সে যেন হত্যা থেকে হাত উঠিয়ে নেয়।’

এ ব্যক্তি মনে করলাে, আমরা এখন যুদ্ধাবস্থায় আছি। আর রাসূল (সাঃ) কোরাইশদেরকে ঘরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা হত্যার শিকার হয়। অতএব যে ঘর ছাড়া অন্য কোথাও থাকবে, সে হত্যার যােগ্য হবে। ‘সে যেন হত্যা করা থেকে হাত উঠিয়ে নেয়।’ রাসূলের এ কথা থেকে লােকটি বুঝল যে, খালিদ সামনে যাকে পাবে, তাকেই হত্যা করবে। একপর্যায়ে তরবারিসহ হাত গুটিয়ে নেবে। কারণ তখন সে আর কাউকে হত্যা করার মতাে পাবে না। নিজের বুঝ অনুযায়ী লােকটি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-এর কাছে এসে চিৎকার করে বললাে, “খালিদ! রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তুমি যাকে পাও তাকে হত্যা কর!”

এরপর খালিদ (রাঃ) সত্তরজন লােককে হত্যা করলাে।

অপর এক ব্যক্তি এসে রাসূল (সাঃ)-কে জানাল, আল্লাহর রাসূল! খালিদ তাে হত্যা করেই চলছে। রাসূল (সাঃ) অবাক হলেন। নিষেধ করা সত্ত্বেও খালিদ হত্যা করছে। তিনি খালিদকে ডেকে পাঠালেন। খালিদ উপস্থিত হলাে।

রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘আমি কি তােমাকে হত্যা করতে নিষেধ করি নি?’ রাসূলের এ কথা শুনে খালিদও আশ্চর্য হয়ে বললাে, “আল্লাহর রাসূল! অমুক ব্যক্তি তাে আমাকে বলেছে, আপনি বলেছেন, যাকে পাও তাকে হত্যা কর।”

তখন রাসূল (সাঃ) সে ব্যক্তিকে ডেকে পাঠালেন। সে এসে দেখলাে, খালিদও উপস্থিত। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, আমি কি হত্যা করা থেকে হাত উঠিয়ে নিতে বলি নি?’

লােকটি তার ভুল বুঝতে পারল। কিন্তু যা হওয়ার, তা তাে হয়ে গেছে । তখন সে বললাে, আল্লাহর রাসূল! আপনি একটা চেয়েছেন, আর আল্লাহ চেয়েছেন আরেকটা। আর আল্লাহর ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে। যা হওয়ার ছিল তা হয়ে গেছে।

রাসূল থেমে গেলেন। তাকে আর কিছু বললেন না।

জীবনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে যে চিন্তা করবে তার কাছে এ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, অনেক সময় মানুষ তার সাধ্যের চেয়ে ভালাে কাজ করে ফেলে।

একবার আমি এক যুবকের সঙ্গে তার গাড়িতে চড়লাম। দেখলাম সে গাড়ি খুব সুন্দর চালায়। আমি জানতাম, এক সপ্তাহ আগে সে একটি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল।

আমি তাকে বললাম, ‘তুমি তাে খুব সুন্দরভাবে গাড়ি চালাও’। এক সপ্তাহ আগে দুর্ঘটনার শিকার হলে কেন?

সে উত্তর দিল, আমি বাধ্য ছিলাম।

“মানে?”

‘হ্যা! অ্যাকসিডেন্ট না করে আমার উপায় ছিল না। জানেন, কেন?

‘কেন?

‘আমি গাড়ি নিয়ে দ্রুতগতিতে একটি ব্রিজে উঠছিলাম। সেভাবে দ্রুতগতিতে নামতে গিয়ে দেখলাম, আমার সামনে অনেকগুলাে গাড়ি সারিবদ্ধভাবে থেমে আছে। জানি না সামনে কি কোনাে দুর্ঘটনা ঘটেছে, নাকি চেকপােস্ট ছিল। আমি হঠাৎ সারিবদ্ধ অনেকগুলাে গাড়ির মুখােমুখি হয়েছিলাম।

‘আমার সামনে চারটি লেন ছিল। সবক’টি লেনই গাড়িতে পূর্ণ ছিল। তাই আমার সামনে তখন তিনটি পথ খােলা ছিল। এক এই সবগুলাে লেন ছেড়ে ব্রীজের ওপর থেকে পড়ে যাওয়া! দুই, শরীরের পূর্ণ শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরা। এ অবস্থায় আমার গাড়ি উল্টে যাবে। তৃতীয় আরেকটি পথ খােলা ছিল। সেটা ছিল সবচেয়ে সহজ।

আমি বললাম, সেটা কী?

সে বললাে, আমার সামনের চার লেনে দাঁড়িয়ে থাকা চারটি গাড়ির কোনাে একটিকে ধাক্কা দেয়া। আমি হেসে বললাম, আচ্ছা! তুমি কী করেছিলে?

সে বললাে, আমি যথাসম্ভব গতি কমিয়ে নিলাম এবং আমার সামনের গাড়িগুলাের মধ্যে সবচেয়ে কমদামী গাড়িটি বেছে নিয়ে তাতে ধাক্কা দিলাম! এ কথা বলে সে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলাে। আমিও হাসলাম। কিন্তু পরে তার কথাগুলাে নিয়ে ভেবে দেখলাম, আসলেই সে খুব বেশি তিরস্কারের উপযুক্ত নয়। কেননা, তার সামনে সীমিত কয়েকটি পথই খােলা ছিল। আর সে তুলনামূলক সবচেয়ে ভালাে পথটিই গ্রহণ করেছে। সারকথা হলাে, কিছু সমস্যা এমন আছে, যার কোনাে সমাধান নেই। যেমন ধরুন, কারাে পিতা খুব রাগী। পিতাকে সে নানাভাবে বােঝানাের চেষ্টা করলাে। কিন্তু কোনাে লাভ হলাে না। এখন সে কী করবে? পিতাকে ছেড়ে চলে যাবে? না তাকে নিয়েই থাকতে হবে। কেননা, তার পিতার প্রকৃতি পাল্টানাের সাধ্য তার নেই।

কথার বাঁকে..

“নিজেকে তিরস্কৃতের অবস্থানে রেখে। তার দৃষ্টি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। এরপর তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন।”

উৎসজীবনকে উপভোগ করুন (Enjoy your life in bangla)

Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.

Leave a Comment