একটি জন্ম সনদের আকুতি (স্বাধীনতা দিবসের গল্প ২০২২)

কানাডার রোদেলা সকালের হালকা রোদ এসে পড়েছে জুনিয়র স্কুলের দেয়ালে। জানালার পাশে বসা শায়লা ক্লার্কের গায়ে এলিয়ে পড়ছে সেই রোদ। অন্যমনস্ক শায়লার এই মিষ্টি রোদে কিছু আসে যায় না। যদিও সবাই খুব উপভোগ করে সকালের এই কাঁচা রোদ। কিন্তু কেন জানি শায়লা তা উপভোগ করতে পারে না। ইদানিং বেশকিছু প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট শায়লা, যে এবারে ক্লাস ফোরে উঠেছে। সে ছোট্ট হলেও তার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো মোটেই ছোট নয়।

জন্ম সনদের গল্প - স্বাধীনতা দিবসের গল্প ২০২২সে হেনরি ক্লার্ক এবং পেগটি ক্লার্কের সন্তান। তারা দুজনই শেতাঙ্গ। কিন্তু তার রঙ মোটেই তাদের মতো নয়। স্কুলে সে সবার গায়ের রঙের চেয়ে তার গায়ের রঙে কেন জানি আলাদা। কেননা তার গায়ের রঙ শ্যামলা তামাটে। এইজন্য প্রায় তাকে কটু কথা শুনতে হয় সহপাঠীদের কাছ থেকে। এমনকি এও শুনতে হয় সে পালক সন্তান। অনেকেই অনেক কথা বলে যা সে পছন্দ করে না। তাছাড়া তার গলায় একটি চেইন আছে, যা মোটেই এইদেশের চিহ্ন বহন করে না। অনেক পুরনো চেইনটি কালের ধারায় ধূয়ে মুছে বিবর্ণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বাবা মার কারণে এটা ফেলতেও পারছে না। অথচ সামান্য চেইনের জন্য স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক টিটকারী সহ্য করতে হয়। সবকিছু থেকে বিরক্ত হয়ে একসময় বাধ্য হয় তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে, “আমি কি সত্যিই তোমাদের সন্তান?

দশ বছরের ছোট্ট শায়লার মনের ব্যথা বুঝতে পেরেছিল হেনরি ক্লার্ক। কিন্তু মুখে কখনোই কিছু বলেননি। শুধু ভালবাসার নিবিড় আবরণে বুকে জড়িয়ে এটাই বুঝালেন যে আমিই তোমার সত্যিকারের বাবা। কিন্তু ছোট্ট শায়লার এতো ভালবাসায়ও মন ভরে না। কেননা সে জানে সে তাদের সন্তান। কিন্তু তাদের সন্তান হলেও কেন তার গায়ের রঙ তাদের চেয়ে আলাদা। তাছাড়া এই বিদঘুটে চেইনের রহস্যই বা কী?

তার এই প্রশ্নের উত্তর পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হলো আরো অনেক বছর। যখন তার বয়স আঠারো হলো তখনই জানতে পারল সেই সত্যটা। যে সত্য জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিলো তার মন এতটা বছর। যে সত্য সে কখনো কল্পনা করে নি সেই সত্যই তাকে শুনতে হলো -শায়লা আসলেই হেনরি এবং পেগটির সন্তান নয়।

যখন শায়লা এই সত্য জানতে পারল তখন নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বয়স তার হয়ে গেছে। তাই সে এটা নিয়ে তেমন মন খারাপ করেনি। কিন্তু যে সত্য জানার পর নিজের জন্মের প্রতি একধরনের ঘৃণা জন্মালো সেটা খুবই কঠিন। সে কোনো এক পরিচয় হারা সন্তান হতে পারত। তাতে কিছুই যায় আসে না। শত শত সন্তান এভাবেই পৃথিবী আসছে। কিন্তু যখন জানতে পারল ও একটি যুদ্ধ শিশু, তখন কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। যখন জানতে পারল তার জন্মের করণ ইতিহাস। তখন অজস্র ধারায় অশ্রুবিন্দু প্রবাহিত হতে লাগলো তার নিজেরই অজান্তে।

কী পাশবিক নির্যাতনের ফলে হয়েছে তার সৃষ্টি। তার নির্মম ইতিহাসের বর্ণনা কিছুতেই একটি সন্তান সহ্য করতে পারে না। শায়লা তার পালক পিতা-মাতার কাছ থেকে জানতে পারল সে “বাংলাদেশ” নামক একটি দেশের যুদ্ধশিশু। ঊনিশশো একাত্তর সালে বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নির্দয় ভাবে ধর্ষিত হন শায়লার কিশোরী মাতা। উপর্যুপরি পাশবিক নির্যাতনের ফলে একসময় শায়লার অস্তিত্ব জানান দেয় তার মাতার শরীরে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত নব্য বাংলাদেশে এমন হাজারো শায়লার জন্ম হয়। যাদের কারোরই ছিলো না কোন পিতৃত্বের পরিচয়। যাদের ছিলো না কোন দেশের নাগরিকত্ব। তখন সেইসব অসহায় শিশুদের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবিক সংগঠন। তাদেরই একটি সংস্থা ছিলো কানাডার। তাদের হাত ধরে আজকের শায়লা হয়ে উঠেছে শায়লা ক্লার্ক। আর তার কিশোরী মায়ের স্মৃতি চিহ্নটি তার গলায় থাকা ঐ বিবর্ণ চেইনটি।

এইসব সত্য কথা শুনার পর বারবারই শিউরে উঠেছে শায়লা, তার কিশোরী মাতার অসহ্য যন্ত্রণার কথা ভেবে। আর বারবার ঘৃনায় ক্ষোভে বিতৃষ্ণায় ফেটেছে তার হৃদয় নরপশু বাবাকে কল্পনা করে। হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শায়লা নিজেকে গড়ে তুলে সভ্যতার সভ্য নাগরিক হিসেবে। আর দশজনের মতো তার জীবনেও আসে স্বামী সন্তান। কিন্তু সব পাওয়ার মাঝেও সবসময় একটা অপূর্ণতা থেকেই যেতো। তার প্রতিদিনের ভাবনাতেও জুড়ে থাকতো “বাংলাদেশ” নামক ছোট্ট একটি দেশের প্রতিচ্ছবি। সকল আনন্দ উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে তার মনের ছোট্ট কোণে হামেশাই জেগে উঠত অতীতের কল্পনা স্মৃতি। সে খুঁজতে চাইতো নিজের জন্ম এবং জন্মভূমি। তাই জীবনের এতো বছর পরও সে ঠিকই খুঁজে বের করেছে তার নাড়িকাটার স্থান। সেই নাড়ির টানে শায়লা ছুটে আসে বিজয়ের মাসে এই বাংলাদেশে।

চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশে নিজেকে খুঁজে পায় শায়লা। বাঙালির দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাঁথা সবই নিজের খুব আপন মনে হয়। লাখো বাঙালির ভিড়ে নিজেকেও একজন ভাবে সে। তার গর্ববোধ হয় এমন দেশে জন্মাতে পেরে। মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরকে নিজের জন্মের আতুর ঘর মনেহয় তার। তাই তো সেই দাবি নিয়ে এক অনুষ্ঠানে শায়লা বলে বসে, “আমি একটি জন্ম সনদ চাই। ” লাখো শহীদের রক্তে যে জন্মভূমি পাওয়া, হাজারো মায়ের সতীত্বের বিনিময়ে যে দেশ, সেই দেশে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে নিতে তার এই আবদার। তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় একটি মাত্র আকুতি, “আমি আমার মায়ের ভূমিতে একটি পরিচয় চাই।” সত্যিই কি শায়লার মায়ের রক্তের বিনিময়ে বিজিত দেশে একটি “জন্ম সনদ” পাবে?

গল্প : একটি জন্ম সনদের আকুতি (স্বাধীনতা দিবসের গল্প)

লেখক: সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী (পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।) 

Please follow our Facebook, Twitter, Instagram, Linkedin, Pinterest, Tumblr, And Youtube channels for more updates.

Leave a Comment