প্রতারণার হাসি – ডাক্তারদের কসাইখানার গল্প
শাহেদ ও রফীক। একই কক্ষের দুই খাটে দু’জন শায়িত। তারা পরস্পর বন্ধু। হঠাৎ একটু এলোমেলো স্বপ্ন দেখে শাহেদের ঘুম ভেঙ্গে যায় । কক্ষে মৃদু আলো জ্বলছিল। শাহেদ পাশ ফিরে দেখে রফীক এখনও ঘুমিয়ে আছে। ইতোমধ্যে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কন্ঠ চিড়ে বেরিয়ে আসে আস্সালাতু খাইরুম মিনান্ নাওম। হে মুসলিম নর-নারীরা! আর ঘুমিয়ে থেকো না । কারণ ঘুম থেকে নামাজ উত্তম ।
রফীকের ঘুমন্ত দেহের দিকে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শাহেদ। ওকে দেখে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দীর্ঘ ছয়/সাত বছরের কথা একের পর এক ভাসতে থাকে তার হৃদয় দর্পনে ।
ওরা দু’বন্ধু এক সাথে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। বিশ্ব বিদ্যালয়ের দীর্ঘ জীবন কেটেছে ওদের একই রুমে, একই সাথে। যার সুবাদে ওরা একে অপরের খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় উভয়ের মাঝে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। ফলে প্রত্যেকেই একে অপরের সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার হতো। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসতো একান্ত আপনজনের মতোই। এসব কথা মনে করে শাহেদের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে।
গতকাল ওদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজই ওরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যাবে। চলে যাবে দূরে, বহু দূরে। কে জানে, জীবনে আর কোনো দিন তাদের মোলাকাত হয় কি না?
চোখ মুছে শাহেদ রফীককে ডেকে তুলে। দু’বন্ধু ওদের চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে। নামাজের পর হল রুমে এসে কালামে পাক তিলাওয়াত করে । অতঃপর হালকা নাস্তা সেরে নেয়। ইতোমধ্যে ঘড়ির কাটাও আটের ঘরে চেপে বসে। এবার বিদায়ের পালা ।
ওরা একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। উভয়ের চোখেই পানি। অশ্রুগুলো যেন ভাষা খুঁজে পায়। অব্যক্ত কন্ঠে বলতে থাকে- বিদায় দাও বন্ধু! দিও ক্ষমা করে ।
কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সালাম মোসাফাহা শেষে শাহেদ বগুড়া গামী একটি বাসে গিয়ে উঠে। অল্পক্ষণের মধ্যে বাসটি চলতে শুরু করে। রফীক তখনও বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সে কেবল শাহেদকে নিয়ে চলে যাওয়া বাসটির দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে থাকে ।
বগুড়া শহরের উপকন্ঠে নবীনগর গ্রামে শাহেদদের বাড়ি। ওরা দুই ভাই দুই বোন। শাহেদের পিতা জনাব আব্দুল কাদের একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষক । অবশ্য বর্তমানে তিনি অবসর নিয়েছেন ।
আয়ের উৎস বলতে শাহেদদের তেমন কিছুই নেই। এক বিঘা জমি তিনটি গাভী ও পিতার প্রতি মাসে প্রাপ্ত পেনশনের টাকাই তাদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন। এগুলো দ্বারা টানাটানির মধ্য দিয়ে কোনো রকম তাদের সংসারটা চলে ।
গত দু’মাস হলো পরীক্ষার কারণে বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি শাহেদ। বাড়ি ঘরের বর্তমান কি অবস্থা, আব্বা-আম্মার শারীরিক অবস্থা কেমন? এসব ভাবতে ভাবতে সে বাস থেকে নামে। তারপর প্রায় দু’কিলোমিটার মাটির রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়িতে পৌঁছতেই কেমন যেন নীরবতা অনুমিত হয়। একে তো বন্ধুর বিরহ যন্ত্রণা, তারপর বাড়ির এই গম্ভীর ভাব দেখে শাহেদের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে। সে ভাবে, বাড়ির কারো অসুখ-সুখ হয়নি তো? কিংবা বড় রকমের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?
এসব সাতপাঁচ ভেবে ধীরপদে বাড়ির অঙ্গিনায় পা রাখছিল শাহেদ। ঠিক এমন সময় ছোট বোন সাবিহা দৌড়ে এসে তাকে সালাম দেয় ৷
শাহেদ সালামের জবাব দেয় । কিন্তু সাবিহাকে কেমন যেন বিষন্ন মনে হয় ।
শাহেদ ব্যস্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে- সাবিহা! কেমন আছিস? কোনো অসুখ হয়নি তো?
সাবিহা ছোট্ট করে উত্তর দেয়- না, ভাইয়া! আমি ভাল আছি ।
শাহেদ আবার প্রশ্ন করে- আম্মা কোথায় রে? তাকে তো দেখছি না? সাবিহা নিরুত্তর । সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
শাহেদ আবার জোড় গলায় প্রশ্ন করে- বল্ সাবিহা! আম্মা কোথায়? তিনি কি তাহলে অসুস্থ?
সাবিহা এবার মুখ খুলে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলে- হ্যাঁ, গত এক মাস হলো আম্মা অসুস্থ ।
কি বলি? মা গত একমাস হলো অসুস্থ। অথচ আজ পর্যন্ত আমি কোনো সংবাদ পাইনি । তাহলে তোরা সবাই কি আমাকে ভুলে গিয়েছিস?
সাবিহা আবারো নিরুত্তর। সে কোনো জবাব দিতে পারে না । শাহেদও জবাবের অপেক্ষা না করে হন্ হন্ করে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরে গিয়ে দেখে, মা জননী একটি চৌকির উপর শুয়ে আছেন । শরীরে এক চিমটে গোশ্ত নেই। কংকালসার দেহ। চোখ দুটো কুঠরাগত। শাহেদকে দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারে না ।
মাকে এ অবস্থায় দেখে শাহেদের সহ্য হয় না। বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মতোই দু’চোখ বেয়ে হু হু করে নেমে আসে অশ্রুর বন্যা। চাপা কান্নায় কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। মনকে সে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারে না। বুকের মধ্যে অসহ্য একটা ব্যথা গুমড়ে উঠে। সে মায়ের বুকে মুখ গুজে ব্যাথাকাতর কন্ঠে বলে- মা! মাগো! তোমার একি অবস্থা মা! আমাকে কেন সংবাদ দাওনি? আমি কি তোমাদের সন্তান নই?
মা ছেলের মাথায় হাত রেখে ডুকরে কেঁদে উঠেন। একটা অব্যক্ত বেদনা তার সমস্ত অন্তরটাকে যেন নিষ্পেষিত করে চলে। চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠে বালিশ। খানিক পর নিজেকে সামলে নিয়ে আঁচলে মুখ মুছে বলেন- তোর আব্বা সংবাদ দিতে চেয়েছিল বাবা। কিন্তু আমিই নিষেধ করেছি। আমার অসুখের কথা শুনলে তোর যে লেখাপড়ার ক্ষতি হতো ।
শাহেদ মাথা তুলে বলল- লেখাপড়া? কিসের লেখাপড়া? তুমি দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছ, আর আমি লেখাপড়া নিয়ে বসে থাকবো? কি মূল্য আছে সে লেখাপড়ার?
শাহেদের মা কোনো জবাব খুঁজে পান না। তিনি অশ্রু ছলছল চোখে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ইতোমধ্যে সাবিহা শাহেদের পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলে, ভাইয়া! কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নিন। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সেই কখন রওয়ানা দিয়েছেন । নিশ্চয়ই আপনার পেটে ভীষণ ক্ষুধা আছে শাহেদ চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায় ৷
একমাস হলো শাহেদ বাড়ি এসেছে। কিন্তু অর্থের অভাবে মাকে কোনো ভাল ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি । গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার দিয়েই চিকিৎসা চলল । এতে ফলাফল যা হবার তা-ই হলো। ক্রমশ মায়ের শরীর আরো খারাপ হতে লাগলো।
শাহেদ ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। একদিন সে তার আব্বাকে বলে – আব্বা! মায়ের শরীর তো আরো খারাপ হচ্ছে। এভাবে তো তাকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা যায় না ।
শাহেদের আব্বা জবাবে বললেন-কথা তো ঠিকই বলেছো। কিন্তু কি করবো বাবা! আমি তো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
শাহেদ বলল, আমাদের একটি গাভী বিক্রি করে হলেও মায়ের ভা চিকিৎসা করা দরকার ৷
শাহেদের আব্বা বললেন, তোমার নিকট যা ভালো মনে হয়, তা-ই করো । এতে আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা ।
শাহেদ বিলম্ব করল না। সে একটি গাভী সেদিনই বাজারে নিয়ে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করে ফেলে।
পরের দিন শাহেদ তার মাকে নিয়ে বগুড়া শহরে গেল এবং সেখানকার একজন নামকরা মেডিসিন স্পেশালিস্টের শরণাপন্ন হলো ।
তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শাহেদকে বললেন- আপনার আম্মার একটি কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে। দু’ মাসের মধ্যে নষ্ট কিডনীটি অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে। তা না হলে অপর কিডনীটিও নষ্ট হয়ে যাবে। মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা হলে আমাদের এ ক্লিনিকেই আপনার মায়ের চিকিৎসা চলতে পারে ।
ডাক্তারের কথা শুনে শাহেদের দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা তপ্ত অশ্রু । সে মনে মনে ভাবতে থাকে- হে আল্লাহ! কি করবো এখন? কিভাবে মায়ের চিকিৎসা করাবো? আমরা গরিব মানুষ। এত টাকা কোথায় পাব? আমাদের সব কিছু বিক্রি করলেও তো পঞ্চাশ হাজার টাকা হবে না । তাহলে এখন উপায়?
শাহেদ আর ভাবতে পারে না। সে আবার ডাক্তারের সাথে দেখা করে। মিনতির স্বরে ডাক্তারকে বলে, ডাক্তার সাহেব! দয়া করে অপারেশন চার্জটা কমিয়ে দিন। অন্যথায় আমার আম্মা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমুখে পতিত হবে ।
শাহেদের কথায় ডাক্তার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। রাগত স্বরে বলেন- আপনার মা মরল না বাঁচল সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। এখানে চিকিৎসা করাতে হলে পঞ্চাশ হাজারই লাগবে। একটি কানাকড়ি কম হলেও চলবে না ।
মাকে বাঁচানোর তাগিদে শাহেদ আবারো নিজেদের অসহায়ত্বের কথা ডাক্তারের নিকট বর্ণনা করে। কিন্তু ডাক্তার আপন কথায় অটল তিনি বললেন- এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার। এখন আপনি যেতে পারেন। যা বলেছি তার ব্যবস্থা হলেই আমার সাথে দেখা করবেন : শাহেদ নিরাশ হয়ে গেল। সে ফিরতে ফিরতে ভাবলো, এরই নাম কি মানবতা? মানবসেবা কি একেই বলে? বিপন্ন মানুষের প্রতি একজন ডিগ্রিধারী ডাক্তারের এমন নিষ্ঠুর আচরণ? তাদের সাইন বোর্ডে আবার বড় অক্ষরে লেখা থাকে সেবার কথা? সেবার রূপ কি তাহলে এ-ই? এসব চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত সে নিরুপায় হয়ে মাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসে।
ইতোমধ্যে শাহেদের রিজাল্ট বের হয়। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে সে। রিজাল্টের পর শাহেদ মনে মনে একটি হিসেব করে। সে ভাবে, যদি একটি চাকুরী পাই, তবে এই টাকা দিয়ে সংসার চালানোর একটা ব্যবস্থা হবে। আর এক বিঘা জমি ও অবশিষ্ট দুটো গাভী বিক্রি করে দিলে তাতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়ে যাবে। চাকুরী না পেয়ে ওগুলো বিক্রি করে দিলে ওরা যে সবাই অনাহারে থাকবে। তাই একটি চাকুরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে শাহেদ ।
কিন্তু চাকুরী! সে তো সোনার হরিণ! সবাই তাকে ধরতে পারে না। চাকুরীর জন্য চাই টাকা ও উপর ওয়ালাদের টেলিফোন। কিন্তু এর কোনোটাই যে শাহেদের নেই ।
এরই মধ্যে ডাক্তারের দেয়া সময়ের পনের দিন চলে যায়। শাহেদ একটি চাকুরীর জন্য পাগলের মতো ঘুরতে থাকে। একের পর এক দিতে থাকে ইন্টারভিউ। সে সবগুলো ইন্টারভিউতেই ভাল করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকুরী হয় না। এদিকে মায়ের কথা মনে হলে বুকটা হাহাকার করে উঠে । নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় ওর । শাহেদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল- ওকে ঢাকায় যেতে হবে। বগুড়া থেকে চাকুরীর কোনো ব্যবস্থা হবে না । ঢাকায় গেলে পরিচিত বন্ধুদের সাহায্যে হয়ত একটা কর্ম সংস্থান করা যাবে । মাকে কিছুতেই বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে দেবে না শাহেদ।
একদিন রাতে শাহেদ মায়ের কাছে গেল । বললো, মা! বগুড়া থেকে চাকুরীর কোনো ব্যবস্থা করতে পারলাম না। আমি ২/১ দিনের মধ্যেই ঢাকা যাবার ইরাদা করেছি। এখন শুধু আপনার অনুমতির অপেক্ষায় আছি ।
শাহেদের মা বললেন- আমার জন্য এত পেরেশান হচ্ছিস কেন বাবা! আমার জীবন তো শেষই হয়ে আসছে। তুমি ঢাকা যেও না । আমার মন বলছে- ঢাকা গেলে তুমি আর ফিরে আসবে না বাবা ।
শাহেদ বলল, তুমি নিষেধ করো না মা। আমার চোখের সামনে তুমি তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে, ছেলে হয়ে এ আমি কেমন করে সহ্য করবো মা? তোমার এ অবস্থা আমি আর বরদাস্ত করতে পারছি না। আমাকে তুমি হাসি মুখে বিদায় দাও। দেখবে, তোমার ছেলে এক মাসের মধ্যেই তোমার অপারেশনের টাকা নিয়ে তোমার কোলে ফিরে আসবে।
শাহেদের মা আর কথা বাড়ায় না । তিনি চুপ করে থাকেন । শাহেদ এ অবস্থাকে মৌন সমর্থন মনে করে মায়ের কাছ থেকে উঠে যায় ।
একদিন পর শাহেদ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় । ছোট বোন সাবিহা মাটির ব্যাংকে কিছু টাকা জমিয়ে ছিল। ভাইয়ের বিদায়ের মুহূর্তে সেগুলোই সে তার হাতে উঠিয়ে দেয় ।
সপ্তাহ পেরিয়ে গেল শাহেদ ঢাকা এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চাকুরীর কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি। এভাবে চলে গেল আরো কয়েকদিন । এদিকে ডাক্তারের দেয়া আর এক মাসের মধ্যেই শাহেদের মায়ের অপারেশন করতে হবে। সঙ্গে নিয়ে আসা টাকাগুলোও ইতোমধ্যে শেষ হয়ে এসেছে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে শাহেদ আজও চাকুরীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ল । অনেক ঘুরাঘুরি করল। পরিচিত বন্ধুদের সাথে আবারো সাক্ষাত করল । কিন্তু ফল কিছুই হলো না। অবশেষে নিরাশ হয়ে প্রত্যহের মতো আজও বাংলা বাজার মোড়ে দেয়ালে টানানো বিজ্ঞপ্তিগুলো চাকুরীর সন্ধানে দেখতে লাগলো ।
দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে শাহেদের চক্ষু স্থির হয়ে যায়। বিজ্ঞপ্তি দেখে তার চোখ-মুখ উজ্বল হয়ে উঠে । এতে লেখা ছিল-
‘একটি মুমুর্ষ রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। রক্ত দাতাকে একটি ভাল চাকুরী দেয়া হবে। অতিসত্বর নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করুন ।
বিজ্ঞপ্তি পড়ে শেষ করতেই শাহেদের কানে অনুরিত হতে থাকে ডাক্তারের সেই কথাগুলো-“আপনার মায়ের একটি কিডনী নষ্ট হয়ে গেছে ! দু’মাসের মধ্যে…….. পঞ্চাশ হাজার টাকা হলে……….।
শাহেদ পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করে ঠিকানাটা লিখে নেয়। ওর সামনে সহসাই ভেসে উঠে মমতাময়ী মায়ের বিছানায় পড়ে থাকা কংকালসার দেহটি ।
শাহেদ আর সময় নষ্ট করল না। বিজ্ঞপ্তির ঠিকানা অনুযায়ী দ্রুত একটি ক্লিনিকে গিয়ে হাজির হলো।
শাহেদ রক্ত দিতে এসেছে জানতে পেরে ক্লিনিকের মালিক শাহেদকে স্বাগত জানান এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে ডাক্তারের রুমে নিয়ে যান ।
ডাক্তারের কাছে শাহেদ সবকিছু খুলে বলে। ডাক্তার শাহেদকে দেখে বললেন- এক ব্যাগ রক্ত দিলে আপনার কোন সমস্যা হবে না । রক্ত দেয়ার পরও আপনি সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবেন। পুরস্কার স্বরূপ আপনি পাবেন ভাল একটা চাকুরী। আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী আপনাকে যে চাকুরী দেওয়া হবে তাতে কম করে হলেও আপনার বেতন সাত হাজার টাকার কম হবে না। তা দিয়ে অনায়েসে সংসারের খরচ বহন করতে পারবেন ।
ডাক্তারের কথায় শাহেদ খুশি হয়। সে রাজি হয়ে যায়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, চাকুরীটা হওয়া মাত্রই সে বাড়িতে সবাইকে খবরটা জানিয়ে আসবে ।
ডাক্তার শাহেদকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। তারপর নির্দিষ্ট স্থানে তাকে শুইতে বলে। শাহেদ ডাক্তারের নির্দেশ পালন করে। তবে সেখানে যাওয়ার পর সে যেন ডাক্তারের মুখে একটি প্রতারণার হাসি দেখতে পায়। কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না তার। কেননা এতক্ষণে দু’জন বলিষ্ট যুবক তার দু’বাহুতে শক্ত করে চেপে ধরেছে। আর ডাক্তার তাকে অজ্ঞান করার জন্য ইনজেকশন পুশ্ করে দিয়েছে ।
যখন শাহেদ প্রতারণার জালে আটকে পড়ার কথা বুঝতে পারে তখন সে জোড়ে একটি চিৎকার দিয়েছিল। কিন্তু তার এ চিৎকার কক্ষের চার দেয়াল ভেদ করে বাইরে যেতে পারেনি। কিংবা গেলেও সেখানে হয়ত এমন কোনো হৃদয়বান লোক ছিল না, যিনি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন ।
শাহেদ অজ্ঞান হওয়ার পর ওর শরীরের মূল্যবান অঙ্গগুলো একে একে কেটে বের করে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে শাহেদের নির্মম মৃত্যু ঘটে। সে চলে যায় পরজগতে। যেখান থেকে আর কোনোদিন সে তার অসুস্থ মায়ের কাছে ফিরতে পারবে না ।
হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর ডাক্তারের আপন কর্তব্য (?) শেষ হওয়ার পর শাহেদের লাশটি টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে গভীর রাতে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। আশে পাশের কেউই জানলো না যে, এই এলাকায় কি নির্মম, কি নিষ্ঠুর, কি পৈশাচিক কান্ড ঘটে গেছে আজকের রাতের অন্ধকারে ।
দিন গড়িয়ে সপ্তাহের পর আসে মাস । বিছানায় কাতর এক মমতাময়ী মা। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে দাঁড়ানো এক অসহায় পিতা। চেয়ে আছেন কলিজার টুকরো পুত্রের জন্য চাতক পাখির মতো। ছোট ভাই বোনগুলো অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে ভাইয়ার আগমনের প্রতীক্ষায়। কিন্তু হায় তাদের সে আশা কি কোনোদিন পূরণ হবে? তারা কি কখনও জানতে পারবে- কোন্ হায়েনার কবলে পড়ে শাহেদের নির্মম মৃত্যু ঘটেছে? কোন্ পাষন্ডের হিংস্র থাবায় তার সকল স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে? না, তারা হয়ত কোনো দিনই এ খবর জানতে পারবে না ।
প্রিয় পাঠক! উল্লেখিত ঘটনায় দু’জন ডাক্তারের কথা আলোচনা এসেছে। তারা ঠান্ডা মাথায় একজন অসহায় ও বিপদগ্রস্থ লোকের সাথে যে ব্যবহার ও আচরণ করেছে, কোনো বিবেকবান লোক কি কোনো দিন তা কল্পনা করতে পারে? একজন ডাক্তার, সেবাই যার মূল উদ্দেশ্য তিনি কেমন করে বলতে পারেন যে, আপনার মা মরুক বা বাঁচুক এতে আমার কিছু আসে যায় না। অপর দিকে আরেক ডাক্তার যার জীবনের মূল উদ্দেশ্য মানব সেবা। সে কি করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সবকিছু জেনে শুনে সুস্থ মস্তিস্কে কেবল মাত্র টাকার লোভে একজন অসহায় ব্যক্তির দেহে অন্যায়ভাবে অস্ত্র পাচার করে তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দিতে পারে?
হ্যাঁ, তা সম্ভব। মানুষের অন্তরে একটি জিনিসের অভাব হলেই তা একশ ভাগ সম্ভব। শুধু তাই নয়- এ জিনিসটির অভাব হলে লোভ হিংসার বশবর্তী হয়ে মানুষ এর চেয়ে জঘন্য ও নৃশংস কাজ আঞ্জাম দিতে পারে। আর হচ্ছেও তাই ।
পাঠকবৃন্দ! আপনাদের হয়ত জানতে ইচ্ছে করছে যে, সেই জিনিসটি কি যার অভাবে মানুষ সুযোগ পেলে যে কোনো অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না?
সেই জিনিসটি হলো, আল্লাহর ভয় । মানুষ যখন প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তা আলাকে ভয় করতে শিখবে, যখন তার হৃদয়ে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব বসে যাবে, তখন প্রকাশ্যে কেন নীরব-নির্জন পরিবেশে, এমনকি শক্ত প্রাচীরের ভিতরেও কোনো অন্যায় কাজ করতে পারবে না। কেননা সে তখন মনে করবে এখানে কোনো মানুষ নেই ঠিকই কিন্তু আল্লাহপাক তো উপস্থিত আছেন। তিনি তো আমাকে দেখছেন। কি করে তার সামনে আমি এ অন্যায় কাজটি করবো? আর যদি করেই ফেলি, তাহলে কিভাবে পরকালে তার সামনে মুখ দেখাব? কিভাবে হাশরের ময়দানে লক্ষ-কোটি মানুষের সামনে এ অন্যায়ের স্বীকারোক্তি দেব। অথচ সেদিন কোনো কিছু গোপন করার সুযোগও থাকবে না ।
তাই, প্রিয় বন্ধুগণ! আসুন আমরা আমাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় ঢুকানোর চেষ্টা করি। তার বড়ত্বকে হৃদয়ে প্রবেশ করাই। আর এজন্য উত্তম পদ্ধতি হলো-
(এক) চলা-ফেরায়, উঠা-বসায়, বাসে-ট্রেনে, স্টিমার-লঞ্চে এক কথায় যখন যেখানে সুযোগ পাওয়া যায় সেখানেই অপরের সাথে আল্লাহ পাকের বড়ত্ব নিয়ে আলোচনা করা ৷
(দুই), আল্লাহর কুদরত ও তার বড়ত্ব-মহত্তের কথা কোথাও আলোচিত হলে তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা ৷
(তিন) আল্লাহ পাকের প্রতিটি সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করা যে, তিনি কত নিপুণ কারিগরী কৌশলের মাধ্যমে এসব সৃষ্টি করেছেন। কত সুন্দর করে পরিমিত ভাবে তিনি এগুলো সৃজন করেছেন। তার সৃষ্টির কোথাও কোনো খুঁত নেই, ত্রুটি নেই ।
এভাবে আমরা যখন আল্লাহ পাকের বড়ত্ব অন্তরে বসানোর জন্য ফিকির করব, তখন আস্তে আস্তে দিন দিন আমাদের অন্তরে তা বসতে থাকবে। আর এটা সাধারণ কথা যে, মানুষ যাকে বড় মনে করে তাকেই সে ভয় পায়, তার আদেশ-নিষেধকে সে সর্বান্তকরণে মানতে তৈরি থাকে । হে আল্লাহ! তুমি অপরিসীম করুণাময়। তোমার ভয় আমাদের অন্তরে ঢুকিয়ে দাও। আর এর জন্য যে রাস্তা অবলম্বন করা দরকার, তুমি তার ব্যবস্থা করে দাও। আমীন । ইয়া রাব্বাল আলামীন। *
★ সহায়তায় : মাসিক আদর্শনারী, ফেব্রুয়ারী ২০০০ সংখ্যা।
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফিজুল ইসলাম। লেখকের: যে গল্পে হৃদয় গলে – সিরিজ ১০ বই থেকে সংগ্রহ।