ঈমানদার মা (চার খলীফার ছোট গল্প)

এটি ইমাম শাফেয়ী’র (রঃ) এর শিক্ষা লাভের গল্প। সম্মানিত লেখক ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এর শিক্ষা লাভ জীবনের কিছু ঘটনা গল্পাকারে তুলে ধরেছেন।

ঈমানদার মা (ইমাম শাফেয়ী শিক্ষা লাভের গল্প)

ঈমানদার মা , ইমাম শাফেয়ী ইসলামিক গল্প
একজন ঈমানদান মায়ের গল্প কাহিনী। ছবি: এআই দ্বারা কাল্পনিকভাবে তৈরি। বাস্তবার সাথে মিল নেই।

মাতৃস্নেহ অতুলনীয়। কিন্তু অধিক স্নেহ সন্তানের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনে। আমার জানা মতে অনেক মা এমন আছেন যারা সন্তানকে লেখা পড়ার উদ্দেশ্যে দূরে পাঠাতে একবারেই নারাজ। এতে নাকি তাদের অন্তর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সন্তানের মায়ায় তাদের ঘুম আসে না । খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কাজ-কর্মে মন বসে না ইত্যাদি। বস্তুতঃ একেই বলে অধিক স্নেহ ।

সন্তানের জন্য মাতা-পিতার মায়া-স্নেহ আছেই, থাকবেই । এটা মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। এর ব্যতিক্রম হওয়াটাই অস্বাভাবিক । তবে স্নেহের আধিক্যে যদি সন্তানের মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল হয় তবে সেটাই দোষনীয়, নিন্দনীয় ।

সন্তান বড় হলে তাকে এলমে দ্বীন তথা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে দূরে পাঠাতে হবে। এতে যদি পিতা-মাতার কষ্টও হয় তবুও দ্বীনের খাতিরে, সন্তানের মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য করে তা অবশ্যই বরদাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদেরকে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে হবে । কেননা সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা পিতা-মাতার দায়িত্ব । যে কোন মূল্যে এ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। অন্যথায় কিয়ামতের দিন খোদার সামনে আসামীর কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে। সেদিন শত আফসোস হবে। কিন্তু সে আফসোস তখন কোন কাজে আসবে না ।

আল্লাহ মাফ করুন। কোন কোন মা এমনও আছেন যারা ইলমে দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে সন্তানকে দূরে পাঠিয়ে তার বিরহ যন্ত্রণা বরদাশ করেন ঠিকই কিন্তু নিয়ত বিশুদ্ধ না হওয়ার করণে তারা খোদা প্রদত্ত ছাওয়াব ও পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের নিয়ত সাধারণত এরূপ হয় যে, আমার সন্তান ভবিষ্যতে বড় কোন আলেম বা বিখ্যাত ওয়ায়েজ হবে এবং সে তার ইলম ও ওয়াজের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা ও সুনাম কামাই করবে। এতে আমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা যেমন আসবে তেমনি সম্মানও বৃদ্ধি পাবে ।

অথচ ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই সন্তানকে এলমে দ্বীন অর্জন করতে মাদরাসায় পাঠানো উচিত ছিল ।

আমরা এখন এমন এক মায়ের কাহিনী শুনব যিনি আপন সন্তানকে ইলমে দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে শত শত মাইল দূরে পাঠিয়ে শুধু সন্তানের বিরহ যন্ত্রণাই বরদাশত করেননি, বরং তার এখলাছ, নিয়ত এবং দুনিয়ার সম্পদের প্রতি অনাসক্তি কিয়ামত পর্যন্ত আগত মাতাদের জন্য বিরাট এক দৃষ্টান্ত হতে পারে ।

প্রসিদ্ধ চার ইমামের একজন হলেন ইমাম শাফেয়ী (র.)। তিনি ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের সোনালী মহাপুরুষ। ইলমী জগতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা । মক্কায় জন্ম গ্রহণ করলেও তার শিক্ষা জীবনের অধিকাংশ সময় মদীনা শরীফেই কেটেছে। স্নেহময়ী বৃদ্ধা মাতাই তাকে ইলমে দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে সদূর মদীনায় পাঠিয়ে ছিলেন ।

ইমাম শাফেয়ী (র.) এর মাতা আপন সন্তানকে যথেষ্ট আদর স্নেহ করতেন। বৃদ্ধ বয়সে তার নিকট সন্তানের উপস্থিতি ছিল একান্ত প্রয়োজন । তাদের আর্থিক অবস্থাও ছিল খুবই খারাপ এতদসত্বেও একমাত্র ইলমে দ্বীন শিক্ষার উদ্দেশ্যে স্নেহের সন্তানকে বহু দূরে পাঠিয়ে দিতে মোটেও কুন্ঠাবোধ করেননি তিনি ৷

ইমাম শাফেয়ী (র.) নিজেই আপন শিক্ষা জীবনের একটি চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আমার মমতাময়ী মা যখন আমাকে মদীনায় ইমাম মালেক (র.) এর খেদমতে পাঠান তখন আমার নিকট দুটো চাদর ছাড়া আর কোন সম্বল ছিল না। একেবারেই নিঃস্ব অবস্থায় ছিলাম আমি। দেয়ার মতো কোন টাকা-কড়িও তার নিকট ছিল না। ছিল কেবল পাহাড়সম হিম্মত, অপরীসীম উৎসাহ ও কেঁদে কেঁদে কায়মনোবাক্যে মহান প্রভুর দরবারে আকুল প্রার্থনা ।

আজ বেশ ক’বছর যাবত আমি ইমাম মালিক (র.) এর দরবারে ইলমে দ্বীন অধ্যয়ন করছি। নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা গ্রহণ শেষ করার পরও আরও অধিক জ্ঞান অর্জনের জন্য আমি তার নিকট ইলমে দ্বীনের চর্চা ও অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন সেই পাড়া গায়ের এক ঝুপড়ীর মাঝে রেখে আসা সহায়-সম্বলহীন মায়ের স্মরণ আমাকে খুবই ব্যাকুল করে তুলল । মায়ের পুত-পবিত্র মুখখানা দেখার জন্য আমি ক্রমেই অস্থির হয়ে পড়লাম ।

ধীরে ধীরে আমার সেই অস্থিরতা বেড়েই চলল। এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে আমি আপন উস্তাদের নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করলাম। বললাম, মুহতারাম উস্তাদজী! বাড়ীতে আমার বৃদ্ধা মা আছেন । আজ ক’দিন যাবত তার খেদমতে হাজির হওয়ার জন্য আমার মন-প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। আপনার সদয় অনুমতি হলে আমি আমার মনের ঐকান্তিক ইচ্ছাটুকু পূরণ করতে পারতাম ।

আমার বক্তব্য শুনে ইমাম মালেক (র.) বললেন, তুমি দেরী না করে এক্ষুনি সফরের জন্য তৈরী নাও। আমার ইচ্ছা, তুমি দ্রুত মায়ের খেদমতে হাযির হবে এবং তার চেহারা দর্শন লাভে আপন কলিজা ঠান্ডা করবে ।

উস্তাদের অনুমতি পেয়ে আমি সীমাহীন আনন্দিত হলাম এবং তৎক্ষনাৎ সামানপত্র গুছিয়ে সফরের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। এদিকে মুহতারাম উস্তাদ আমার আম্মার নিকট এ মর্মে সংবাদ পাঠালেন যে, বেশ কয়েক বছর পূর্বে যে সন্তানকে আপনি দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য মদীনায় । পাঠিয়েছিলেন, যাকে নিয়ে আপনি বৃহৎ আশার বীজ বপন করেছিলেন আর রাত জেগে জেগে মহান মাওলার দরবারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন আপনার সে ফরিয়াদ বিফলে যায়নি। আপনার সে বীজ বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়ে ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে আগামীকালই আপনার খেদমতে হাযির হতে যাচ্ছে।

আমার সফরের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হল। অবশেষে আপন উস্তাদ ইমাম মালেক (র.) ও সংশ্লিষ্ট সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অত্যন্ত জাকজমক পূর্ণ অবস্থায় শাহী হালতে মক্কার পথে রওয়ানা দিলাম । আমার সামনে পিছনে ছিল বেশ কয়েকটি খোরাসানী ঘোড়া ও মিশরী গাধা । রকমারী আসবাবপত্র রং বেরংয়ের কাপড়-চোপর, বিভিন্ন প্রকার ফল- ফলাদি ও অসংখ্য দিনার-দিরহামে এগুলো বোঝাই ছিল। এভাবেই আমি অত্যন্ত আড়ম্বড়তার মধ্য দিয়ে বাড়ীর দিকে এগিয়ে চললাম ।

জীবনে আমি বহু সফর করেছি। কিন্তু আজকের সফরটি বেশ দীর্ঘ মনে হল । পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। গোটা রাস্তায় আমার মনের পর্দায় ভেসে আসছিল মক্কার অলী-গলীর দৃশ্য আর আমার বৃদ্ধা মায়ের মলিন মুখ যে মুখে আজ আমার দর্শন লাভে হাসি ফুটে উঠবে। কখনো আপন কানে ধ্বনি হচ্ছিল মমতাময়ী জননীর স্নেহের ডাক। কখনো বা স্মরণ হচ্ছিল পুরানো সেই সঙ্গী সাথীদের কথা যাদের সাথে জীবনের এক বিরাট অংশ হেসে খেলে আনন্দঘন পরিবেশে কাটিয়েছি। এই বিজন মরুপথে আরও কত কথাই না মনে পড়ছিল আমার ।

চলতে চলতে এক সময় আমি হেরেম শরীফের সীমানায় ঢুকে পড়লাম। দূর থেকে হেরেম শরীফের মনমুগ্ধকর দৃশ্যে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম আমি। এক স্বর্গীয় অনুভূতি আমার হৃদয় মাঝে তখন তোলপাড় খাচ্ছিল । এভাবে আরো কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর আরেকটি অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আনন্দের আতিশায্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম । হেরেম শরীফের সীমানায় এমন একটি সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাব তা আমার কল্পনায়ও কোনদিন আসেনি ।

আমি দেখলাম কয়েকজন মহিলার সাথে আমার দূর্বল বৃদ্ধা মাও তার মায়াভরা স্নেহের কোল সম্প্রসারিত করে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। মাকে দেখে আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম এবং এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমেই আমি মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লাম। মা আমাকে স্বস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং দীর্ঘ সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন।

এরপর আমার বৃদ্ধা খালা আমার সামনে এগিয়ে এলেন এবং একইভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন। অতঃপর আমার কপালে একটি চুমু খেয়ে এক অভাবনীয় আবেগে একটি শের পাঠ করলেন । যার অর্থ-

মউতের উত্তাল তরঙ্গ আজো তোমার মাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি। বৎস! প্রতিটি মাতৃহৃদয়ে তোমার জন্য স্নেহ মমতা পুঞ্জিভূত হয়ে আছে ।

মক্কার মাটিতে স্নেহময়ী মা ও আপনজনদের সাক্ষাতে আমার হৃদয়ে এক আনন্দের হিল্লোল বয়ে চলল। মনের গহীন কোনে সৃষ্টি হল এক আশ্চর্য ধরণের অনুভূতি। এক অভাবনীয় প্রশান্তিতে ভরে উঠল আমার হৃদয়-মন।

ইতিমধ্যে আমাকে ঘিরে মক্কার অনেক নারী-পুরুষ এবং ছোট শিশুরা একত্রিত হয়ে গেছে। তাদের সাথে আলাপ আলোচনা ও কুশল বিনিময়ে সেখানে বেশ সময় কেটে গেল। এরই মধ্য দিয়ে কখনো আমি বৃদ্ধা মায়ের দিকে, আবার কখনো বা সঙ্গে নিয়ে আসা মাল পত্রের দিকে তাকাতে লাগলাম ।

হঠাৎ গভীর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম, তার মুখে কোন হাসি নেই। নেই পূর্বের ঐ আনন্দ উল্লাস যা প্রথমে আমি দেখেছিলাম । তার চেহারায় তখন দেখা যাচ্ছিল মলিনতার একটি স্পষ্ট ছাপ। মনে হল, কে যেনো এক পোচ কালি দিয়ে তার সুন্দর মুখখানা ঢেকে দিয়েছে। বিষণ্নতার একটি কালো আবরণ তার সমস্ত মুখে ছড়িয়ে রয়েছে।

ব্যাপারটি আমাকে ভাবিয়ে তুলল। মুহূর্তে আমার সকল আনন্দ মাটি হয়ে গেল । মায়ের অবস্থা এমন কেন হল তা জানার জন্য আমার হৃদয় – মন ছটফট করতে লাগল । তখন কোন কিছুই ভাল লাগছিল না আমার । দ্রুত পদে মায়ের নিকট এগিয়ে গেলাম । বললাম, মা! আপনি বিষণ্ন কেন? কেন আপনার চেহারায় আগের মতো হাসি নেই। কেন আপনার সমস্ত চেহারা জুড়ে মলিনতার সুষ্পষ্ট ছাপ। তাহলে কি আমি আপনাকে কোন কষ্ট দিয়েছি? না আমার কোন আচরণে আপনি কষ্ট পেয়েছেন? স্নেহময়ী মা আমার! আপনার এ অবস্থা আমি কিছুতেই বরদাশত করতে পারছি না। যতক্ষণ না আমি আপনার চেহারায় আগের মত হাসি ফোটাতে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। অস্থিরতার আগুন হৃদয়ের সর্বত্র দাউ দাউ করে জ্বলবে। প্রিয় মা আমার! মেহেরবানী করে আপনার মনের কথাটুকু খুলে বলুন। বর্তমান পরিস্থিতি আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আমার কথা শুনে মা ধীরে ধীরে মুখ উঠালেন । তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, বেটা! তোমার কি স্মরণ নেই আমি যখন তোমাকে দ্বীনি ইলম শিক্ষার জন্য বিদায় দিচ্ছিলাম আমার কাছে তখন দুটি চাদর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ইলমে দ্বীনের প্রতি তোমার আগ্রহ দেখে আমার একমাত্র সম্বল সেই দুখানা চাদরই তোমাকে দিয়েছিলাম । তুমি ছিলে তখন একেবারেই নিঃস্ব-অসহায়। তোমার হাতে কোন টাকা কড়িও দিতে পারিনি আমি। আমার মনে তখন এ আকাংখা ছিল যে, তুমি হাদীসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পদ নিয়ে ফিরে আসবে । কিন্তু বেটা! তুমি ইলমে হাদীসের সম্পদতো এনেছো ঠিকই কিন্তু তার সাথে এসব ধন-সম্পদ যা এনেছ তা তো অহংকারের সামান। তুমি কি এসব সম্পদ এজন্য এনেছ যে, তোমার চাচাতো ভাইদের উপর নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করবে? তাদেরকে তোমার তুলনায় হীন ভাববে?

মায়ের মুখের আশ্চর্যজনক কথা শুনে আমি নির্বাক, নিস্তদ্ধ। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। বৃদ্ধা মায়ের মুখ পানে নিবিষ্ট চিত্তে তাকিয়ে ভাবলাম, আল্লাহু আকবার! দুনিয়ার সম্পদের প্রতি মায়ের এ কেমন আশ্চর্য মুখাপেক্ষীহীনতা, ইলমে দ্বীনের এ কেমন বেনযীর মূল্যায়ণ, আর মহান আল্লাহর প্রতি এ কেমন অবিচল ভরসা ।

কথাগুলো ভাবতেই মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও হাজার গুণে বেড়ে গেল । দুচোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু টপটপ করে নীচে গড়িয়ে পড়লো । সাথে সাথে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে, আমি যা কিছু লাভ করেছি তা আমার মায়ের নযীরবিহীন দ্বীনদারী উন্নত ধ্যান-ধারণা আন্তরিক দোয়া এবং রাব্বুল আলামীনের প্রতি অসীম ভরসার বদৌলতেই লাভ করেছি। আমি অনুভব করলাম, দীর্ঘ দিন পড়া-লেখা আর দ্বীনি শিক্ষার কাজে বিদেশে কাটিয়ে দেয়ার পরও এ উঁচু-নীচু পর্বত টিলার নীচে আজ মায়ের কাছ থেকে যে শিক্ষা পেলাম তা আজীবন আমার হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবে ।

অবশেষে আমি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সীমাহীন মহব্বত সহকারে মায়ের হাতে একটি চুমু খেয়ে বললাম, মা! আমায় বলে দিন, এখন আমি কি করব?

মা বললেন, বেটা! কি আর করবে? গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ঘোষণা করে দাও- এতীম-অনাথ ও দুঃস্থ লোকেরা এখানে এস। যার খাবার নেই খাবার নিয়ে যাও। যার কাপড় নেই কাপড় নিয়ে যাও। অনুরূপভাবে যার যা প্রয়োজন তা এখন থেকে নিয়ে আপন অভাব দূর কর ।

মায়ের নির্দেশ শিরোধার্য। তাই সাথে সাথে আমি চতুর্দিকে লোক পাঠিয়ে ঘোষণা দিলাম। এতে কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই লোকজন আসতে লাগল আর আমি সাহায্য দিতে লাগলাম । দিতে দিতে এক সময় দেখা গেল আমার নিকট কেবল একটি মাত্র খেজুর ও পনেরটি দিনার অবশিষ্ট আছে। আমি এগুলো না দিয়ে মাকে নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম ।

আমার হাতে একটি লাঠি ছিল। হঠাৎ হাত থেকে লাঠিটি নীচে পড়ে গেল। এ সময় ঐ পথ ধরে এক চাকরানী পানির মশক পিঠে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। আমার লাঠি খানা পড়ে যেতে দেখে সে দ্রুত এগিয়ে এসে তা আমার হাতে তুলে দিল ।

চাকরানীর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আমি তাকে দেয়ার জন্য পকেট থেকে পাঁচটি দিনার বের করলাম। আমার মা তা দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বেটা! তোমার নিকট কি এ পাঁচটি দিনারই অবশিষ্ট আছে?

আমি বললাম, না আম্মাজান, আমার নিকট আরও দশ দিনার আছে। : আচ্ছা বেটা! ঐ দশ দিনার কি জন্যে রেখেছ?

: প্রয়োজনের সময় খরচ করার জন্যই আমি এ দশ দিনার রেখে দিয়েছি। মাল-পত্র, খাবার যা এনেছিলাম, আপনার নির্দেশে সবইতো বিতরণ করে দিয়েছি। হয়ত এ দশ দিনার আজই আমাদের কাজে লাগবে ।

: বেটা! দশটি দিনারের উপর তোমার এত ভরসা! অথচ তোমাকে আমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি সকল প্রাণীর প্রয়োজনীয় রিযিকের ব্যবস্থা করেন, তার উপর তোমার কোন ভরসা নেই? খোদার উপর এ কেমন আস্থা তোমার? শোন! যদি আমার সন্তুষ্টি চাও তাহলে এক্ষুনি অবশিস্ট দশ দিনারও চাকরানীকে দিয়ে দাও ।

মায়ের কথা মত আমি অবশিষ্ট দশ দিনারও মেয়েটির হাতে তুলে দিলাম। এবার আমার হাত একেবারেই শূন্য। কিন্তু হাত শুন্য হলে কি হবে মায়ের নির্দেশ পালন করার বরকতে আমার হৃদয়ের সমস্ত অংশ ছিল প্রাচুর্যতায় ভরপুর । যেমনটি আগে কখনো হয়নি আমার ।

আমার হাত সম্পূর্ণ শূন্য হওয়ার পর আম্মাজান মহান আল্লাহর শোকর আদায় করলেন এবং আমাকে স্নেহের স্বরে ডাক দিয়ে বললেন, বাবা! এবার তুমি সেই অবস্থায় আপন জীর্ণ কুটিরে প্রবেশ কর যে অবস্থায় একদিন তুমি এখান থেকে বের হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আজ আমি এপূর্ণ কুটিরে ঐ রৌশনী লাভ করব যা ইতিপূর্বে কখনো লাভ করিনি ।

অতঃপর তিনি বললেন, বেটা! তোমার পেশানীতে আল্লাহ পাক ইলমের নূর দান করেছেন। আমি চাই না এ নূর দুনিয়ার এ তুচ্ছ সম্পদের দ্বারা কলংকিত হোক ।

বেটা! তোমার কি স্মরণ নেই তোমাকে বিদায়ের প্রাক্কালে আমি করুনাময়ের কাছে দোয়া করেছিলাম, হে দয়ার সাগর! তুমি আমার সন্তানকে ইলমী আকাশের উজ্জল প্রদীপ বানিয়ে দাও। বেটা! আমি চাই না, দুনিয়ার সামান্য ধন-সম্পদের কারণে সে প্রদীপের কিছুটা হলেও ম্লান হোক এবং ইসলামী জগত তার পরিপূর্ণ আলো থেকে বঞ্চিত হোক ।

বস্তুতঃ ইমাম শাফেয়ী (র.) এর মায়ের এ উপদেশ সত্যিকার অর্থেই স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। একেই বলে ঈমানদার মা এবং এরই নাম যথার্থ শিক্ষা ও প্রকৃত অর্থে মায়ের আদর । বর্তমান যুগের মায়েরা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন কি? (সুত্রঃ বেহেশতী হুর)

লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। লেখকের যে গল্পে অশ্রু ঝরে – হৃদয় গলে সিরিজ ৮ থেকে সংগ্রহিত।

Leave a Comment