এমন শাসক পাব কি আর (ন্যায় বিচারক শাসকের গল্প)

এ গল্পটি একজন ন্যায় বিচারক শাসক সুলতান মাহমুদ গজনবী’র যিনি তার শাসনকালে এক নারীকে উত্যক্ত করার অপরাধে অপরাধীর গর্দান থেকে মাথা দ্বিখন্ড করে ফেলেছিলেন। গল্পের লেখক সুলতান মাহমুদের জীবনের এই ছোট গল্পটি বর্ণনা করেছেন। 

গল্প : এমন ন্যায় বিচারক শাসক পাব কি আর? 

শাসক

সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি এ বিশ্ব চরাচরে আবির্ভূত হয়েছেন অসংখ্য মহামানব। যাদের যশ-খ্যাতি ও বৈপ্লবিক কর্মকান্ড আজও ইতিহাসের সােনালী পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। সুমহান চরিত্র ও অনুপম কীর্তির জন্য এসব মনীষী মানব হৃদয়ে চিরকাল অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন। দিগন্ত বিজয়ী সুলতান মাহমুদ গজনবী ছিলেন এসব মহামনীষীরই একজন। বক্ষমান আলােচনায় তারই একটি ছােট্ট ঘটনা পাঠক ভাই-বােনদের সম্মুখে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।

প্রচন্ড শীতের রজনী। কুয়াশার ঘন কালাে চাদর গ্রাস করে নিয়েছে পৃথিবীকে। সুলতান মাহমুদ আপন কক্ষে ঘুমিয়ে আছেন। চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ। রাস্তায় লােকজনের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগেই। নগরীর সবাই ঘুমের ঘােরে অচেতন। কিন্তু হঠাৎ করে কেন যেন সুলতানের ঘুম ভেঙ্গে গেল।

সুলতান বারবার ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসছিল না। মনে হলাে, ঘুম যেন তার চোখ থেকে শত কোটি মাইল দূরে চলে গেছে। তিনি ভাবতে লাগলেন, এমন হওয়ার কারণ কি? এমনতাে আর কোনাে দিন হয়নি। তাহলে কি কোনাে মজলুম ব্যক্তি ফরিয়াদ নিয়ে এসেছে? নাকি কোনাে ক্ষুধার্ত ব্যক্তি ক্ষুধার যন্ত্রণায় পিষ্ঠ। হয়ে আমার নিকট খাবারের আশায় এসেছে? হয়তাে বা তাই হবে।

ইতিমধ্যে গােলামও জেগে উঠেছে । সুলতান মাহমুদ গােলামকে বললেন, দেখতাে, কেউ কোনাে হাজত নিয়ে আমার দরবারে এসেছে কিনা।

গােলাম বাইরে গেল। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কাউকে পেল না। তাই ফিরে এসে সুলতানকে বলল, বাইরে কেউ নেই। আপনি নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ুন।

সুলতান মাহমুদ নিদ্রার জন্য আবারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেই একই অবস্থা। কিছুতেই চোখে ঘুম এলাে না। এবার তিনি চিন্তা-ভাবনা করে আবার গােলামকে বাইরে পাঠালেন। কিন্তু এবারও সে পূর্বের মতাে সংবাদ শুনাল। বলল, বাইরে কোনাে লােকজন নেই।

 

সুলতানের সন্দেহ হলাে। তিনি ভাবলেন, গােলাম হয়ত ভালভাবে তালাশ করেনি। তাই তিনি নিজেই তরবারী হাতে তল্লাশীতে বের হয়ে গেলেন। এদিক সেদিক অনেক খুঁজাখুঁজি করলেন। কিন্তু তিনিও কাউকে পেলেন না। এবার তিনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন । মনে মনে ভাবলেন, তাহলে কি আমার নিদ্রা না আসার অন্য কোনাে কারণ রয়েছে? না, তা হতে পারে না। দেখি আরেকটু তালাশ করে।

একথা ভেবে তিনি নিকটস্থ একটি মসজিদের উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলেন। মসজিদের কাছাকাছি আসতেই একটি করুণ সুরের কান্না তার কর্ণগােচর হলাে। নিকটে গিয়ে দেখলেন, একজন লােক মসজিদের বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার চক্ষু থেকে অবিরাম ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। সে অস্ফুট স্বরে বলছে ‘যার চিন্তা নেই, সে চিন্তার পেরেশানী বুঝবে কি করে? সারারাত যে আরামের নিদ্রায় বিভাের থাকে, অদ্রিার কষ্ট সে জানবে কি করে? সুলতান মাহমুদের দরজা বন্ধ, তাতে কি? যিনি সুলতানের সুলতান, তার দরজা তাে উন্মুক্ত । মাহমুদ যদিও শুয়ে আছে, তাতে কিছু আসে যায় না। মহান আল্লাহ তাে জাগ্রত আছেন।’

সুলতান মাহমুদ কথাগুলাে মনযােগ সহকারে শুনলেন। লােকটির করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার চোখেও পানি এসে গেল। তিনি দ্রুত লােকটির নিকটে গিয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন

বাবা! মাহমুদের নামে অভিযােগ করছ? অথচ সে তাে দীর্ঘক্ষণ যাবত তােমার তালাশেই ব্যস্ত। তােমার জন্যই তার নিদ্রা বহু দূরে চলে গেছে। যা হােক, এবার বল, তােমার কি কষ্ট। কি উদ্দেশ্যে এত রাতে এখানে এসেছ? তােমার যে কোনাে খেদমতের জন্য আমি প্রস্তুত।

সুলতানের কথা শুনে লােকটি উঠে দাঁড়াল। অতঃপর কেঁদে কেঁদে বলল। হুজুর! বড়ই লজ্জার কথা। আজ রাত্রে এক চরিত্রহীন লম্পট আমার স্ত্রীকে উত্যক্ত করেছে। গভীর রাতে মাতাল হয়ে আমার ঘরে এসে তার ইজ্জত ছিনিয়ে নেওয়ার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলাে, সে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি হবে। তার এহেন দুষ্কর্ম আমার আত্মমর্যাদা বােধে মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। যদি আপনি তরবারীর মাধ্যমে এর প্রতিশােধ না নেন, তবে কেয়ামতের দিন আমার এ হাত আপনার গর্দান মটকে দিবে।

একজন সাধারণ প্রজার এরূপ কথায় মহামান্য সুলতানের ক্রোধাগ্নি জ্বলে উঠারই কথা ছিল। কিন্তু সুলতান মাহমুদ নিজের ঘাড়েই সকল দোষ চাপিয়ে লােকটিকে দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন এখনও কি অভিশপ্ত শয়তান সেখানে আছে? লােকটি বলল, হয়ত এখন সে চলে গেছে। কিন্তু আমার প্রবল আশংকা হচ্ছে যে, আবারও সে মনের ঐকান্তিক বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য আমার বাড়িতে হানা দিবে। আমার স্ত্রীর সম্ভ্রম লুটে নিতে পুনরায় সে আগমন করবে।

সুলতান বললেন, আচ্ছা, তাহলে এখন তুমি চলে যাও। এ বদবত যখনই তােমার বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখবে তৎক্ষনাৎ আমাকে সংবাদ দিবে। সাথে সাথে সুলতান মাহমুদ বাড়ির চৌকিদারকে ডেকে বলে দিলেন, এ লােকটিকে ভাল করে চিনে রাখ । যে কোনাে মুহূর্তে সে এখানে আসবে, সঙ্গে সঙ্গে আমার নিকট পাঠিয়ে দিবে। আমার নিদ্রা কিংবা ব্যস্ততা কোনোেটারই তুমি পরওয়া করবে না। আমার সাথে তার সাক্ষাতের পথে কোনাে কিছুই যেন প্রতিবন্ধক না হয় সেদিকে তুমি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। এতটুকু বলে সুলতান লােকটিকে বিদায় দিয়ে আপন গৃহে এসে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগলেন।

পর পর দু’রাত অতিবাহিত হলাে। সুলতানের খানাপিনা বন্ধ । কেননা এ সংবাদ শুনার সাথে সাথেই তিনি কসম খেয়ে বলেছেন যে, যতদিন পর্যন্ত ঐ নরপিশাচকে সমুচিত শাস্তি দিতে না পারব; তার দেহ থেকে মাথাটা আলাদা করতে না পারব, ততদিন আমি কোনাে খাদ্য গ্রহণ করব না।

তৃতীয় রাতে সুলতান পূর্বের ন্যায় অপেক্ষায় বসে আছেন। হঠাৎ চৌকিদার এসে তাকে সংবাদ দিলে তিনি তৎক্ষনাৎ তরবারী হাতে দ্রুত লােকটির বাড়িতে চলে গেলেন। তারপর ঐ পাপিষ্ট নরপশুকে তলােয়ারের এক আঘাতে দিখন্ডিত করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। অসহায়-অবলা নারীর উপর হস্ত উত্তোলনের সমুচিত সাজা জনমের জন্য বুঝিয়ে দিলেন। তারপর লােকটিকে কাছে ডেকে বললেন

ভাই! তােমার ঘরে কোনাে খাবার আছে কি? থাকলে আমার জন্য অল্প করে নিয়ে এসাে। জবাবে লােকটি বলল, আমার মতাে লােক মহামান্য সুলতানের কতটুকুই বা খেদমত করতে পারে । তবু ঘরে যা আছে, তা যদি সুলতান সাদরে গ্রহণ করেন, তবে নিজেকে ধন্যই মনে করব।

লোকটি ভিতর বাড়িতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর দস্তরখান ও কয়েকটুকরা শুকনাে রুটি নিয়ে ফিরে এলাে। অতঃপর এগুলাে সুলতানের সামনে রাখলে তিনি তা এতটাই আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে আহার করলেন, যেন জীবনে কোনােদিন এত উৎসাহ ও তৃপ্তি সহকারে কোনাে খাবার খাননি।

খাওয়া শেষ হলে সুলতান মাহমুদ লােকটিকে ডেকে বললেন, আমাকে ক্ষমা করে দিবে। কারণ আমি খানার জন্য তােমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু শােন, আসল কথা হলাে, যেদিন তুমি আমার সাথে সাক্ষাৎ করে তােমার দুঃখের সংবাদ শুনিয়েছ, সেদিন থেকেই আমি শপথ করে বলেছিলাম

এ দুরাচার পাপিষ্ঠের মাথা যতদিন পর্যন্ত তার ধর থেকে পৃথক করে তােমার ঘর পবিত্র করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত যে কোনাে খানাপিনা আমার জন্য হারাম।

কিছুক্ষণ পূর্বে আমি দু’রাকাত নামাজ শুকরিয়া স্বরূপ আদায় করেছি। তাতে বােধ হয় তুমি আশ্চর্যবােধ করছ। তবে এখানে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। কেননা আমি ভেবেছিলাম, এ বদবত হয়ত আমার সন্তানদের মধ্য হতে কেউ হবে। কেননা আমার বংশের কোনাে লােক আমার মেজাজ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরও এমন মারাত্মক অপকর্মে লিপ্ত হবে-এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এরূপ উদ্ধত্যপূর্ণ কাজের সাহসিকতা শুধু বাদশাহের সন্তানদেরই হতে পারে। কেননা তারাই সাধারণত নেশা ও অহংকারের বশীভূত হয়ে এ সমস্ত অপকর্ম করে থাকে। তাই আমি বাড়ি থেকে এ ইরাদা করে বের হয়েছি যে, যদি এ কমবখত আমার সন্তানও হয়, তাকেও আমি হত্যা করব। কিন্তু আল্লাহর দরবারে হাজারাে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এজন্য যে, সে আমার সন্তান নয়, অন্য কারও সন্তান। এজন্যেই আমি শুকরানার দু’রাকাত নামাজ আদায় করলাম

মুহতারাম ভাইগণ! একটু চিন্তা করে দেখুন, একজন শাসকের মধ্যে কি পরিমাণ ইনসাফ ও দরদ থাকলে, আপন প্রিয় পুত্রকে পর্যন্ত হত্যার জন্য নাঙ্গা তলােয়ার হাতে নিয়ে রাতের নিকষ আঁধারে একাকী বের হয়ে পড়তে পারেন। কি পরিমাণ খােদাভীরু ও আল্লাহওয়ালা হলে একজন সাধারণ প্রজার স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এরূপ কসম করে বসতে পারেন? প্রিয় পাঠক! আমাদের বর্তমান শাসকগণ যদি এমন ন্যায়পরায়ণ ও খােদাভীরু হতেন, প্রজাদের সুখ-দুঃখের ব্যাপারে যদি এতটা সচেতন হতেন, তাহলে কি পৃথিবীতে এত অশান্তি থাকত? অসহায় অবলা নারীরা কি এভাবে নির্যাতিত হতাে? সম্ভব হতাে কি, তাদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টীম রােলার চালানাের? কখনােই নয়।

এ ঘটনা পাঠ করে শাসক ও নেতা পর্যায়ের লােকেরা যদি নিজেদের আমলকে শুধরে নিত, প্রজা ও অধীনস্থ লােকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতাে, তবে কি ভাল হতাে না? অবশ্যই ভাল হতাে। তবে এজন্য প্রজা ও সাধারণ লােকদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। তা হলাে, নির্বাচনের সময় তারা এমন লােকদের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করবেন যারা প্রকৃত অর্থেই ন্যায়পরায়ণ ও খােদাভীরু। এমন লােক পাওয়া না গেলে প্রার্থীদের মধ্যে যিনি অপেক্ষাকৃত সৎ তাকেই সমর্থন জানাতে হবে; ভােট দিতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি মানুষের সামনে অবশ্যই আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক কথাটি বুঝে সে অনুপাতে আমল করার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।

১. জাওয়ামিউল হিকায়াত, পৃঃ ১১৮-১২১

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। যদি এমন হতাম বই থেকে। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading