বিয়ের গল্প : বুদ্ধির তেলেসমাতি

বুদ্ধির তেলেসমাতি! লেখক এক যুবকের বিয়ের গল্প তুলে ধরেছেন যিনি উচ্চ দেন মোহরের জন্য তাঁর পছন্দের যুবতীকে বিয়ে করতে পারছিলেন না। অবশেষে সেই যুবক ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) পরামর্শে পছন্দের সেই যুবতীকে বিয়ে করতে সক্ষম হোন। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)   সেই যুবককে কি পরামর্শ দিয়েছিলেন তা জানতে চলুন আমরা এই যুবকের বিয়ের গল্প টি পড়ি…

বুদ্ধির তেলেসমাতি-The marriage story of a young. 

টগবগে এক সুদর্শন যুবক। দেখতে যেমন সুন্দর, মনটিও তেমন সুন্দর। বাড়ি ইরাকের কুফা শহরে। ইমাম আবু হানিফা রহ. এর বাড়ির সঙ্গে। দু’বাড়ির মধ্যে মাত্র কয়েকশ গজ ব্যবধান।

যুবকের এখন বিয়ের বয়স। বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই তার। তাই সে বিয়ের কথা ভাবে। মনে মনে টুকটুকে সুন্দরি একখানা বউ খুঁজে। সেই সাথে কল্পনার পাখায় ভর করে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের রঙিন আকাশে ঘুরে বেড়ায়।

খুঁজতে খুঁজতে যুবক পেয়ে যায় মনের মতো একটি বউ। যেমন তার রূপ, তেমন তার গুণ। এক কথায়–অপূর্ব। কিন্তু পেয়ে গেলেই তো হলো না! নিয়ম মাফিক প্রস্তাব পাঠাতে হবে। তারপর দু’দিকে কথা চালাচালি হবে। দেনমোহর ঠিক হবে। কনে দেখা হবে। খোদার ফযলে সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে তবেই না বিয়ের পিঁড়ি!

প্রস্তাব দেওয়া হলো। কথা চালাচালি হলো। বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। তারপর এল–দেনমোহরের কথা।

মেয়ের পিতা মোহর হাঁকলেন। পরিমাণ উল্লেখ করলেন। মোটা অঙ্কের মোহর। যা আদায় করা যুবকের পক্ষে শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, অসম্ভবও বটে।

বিশাল অঙ্কের মোহরের কথা শুনে যুবকের মনে জ্বলে উঠা আশার প্রদীপটা দপ করে নিভে গেল। স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙ্গে চুরে খান খান হলো। মনটা ছেয়ে গেল নিরাশার আঁধারে। যুবক আর ভাবতে পারল না। ঠিক করতে পারল না, এখন তার করণীয় কি। তবে কি যুবকের ‘বউ প্রাপ্তির সুখ-স্বপ্ন’ পূরণ হবে না?

ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মজলিশে প্রায়ই আসা-যাওয়া করত এই প্রতিবেশি যুবক। সেখানেই প্রচুর সময়ও দিত সে। তাই ইমাম সাহেবের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার।

ইমামের পরামর্শে যুবকের বিয়ে করার গল্প

একদিনের ঘটনা…

বিরাট মজলিশ। মজলিশের প্রধান আকর্ষণ ও মধ্যমণী ইমাম আবু হানিফা রহ.। গোটা মজলিশের মধ্যে তার নূরাণী চেহারাটা যেন উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করছিল। মজলিশ চলাকালে কত লোক আসে, কত লোক যায়। নিজেদের সমস্যার কথা বলে। পরামর্শ চায়। ইমাম সাহেব সবার কথা মনোযোগ সহকারে শুনেন। সবাইকে গুরুত্ব দেন। প্রাণখুলে কথা বলেন। পরামর্শ দেন।

একটু আগে মজলিশ শেষ হয়েছে। লোকজন চলে গেছে। এখন কোনো ভিড় নেই। কিন্তু যুবক এখনো যায়নি। এককোণে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। তার চেহারা বলছে-সে যেন কি বলবে, কিন্তু বলতে পারছে না। একরাশ সংকোচ তার গোটা অবয়বকে যেন চাদরের ন্যায় ঢেকে রেখেছে।

ইমাম সাহেবের দৃষ্টি হলো যুবকের উপর। চেনা মানুষ তো। তাই ডেকে একেবারে নিজের পাশটিতে বসালেন। জিজ্ঞেস করলেন–

-কেমন আছো তুমি?

-জ্বী হুজুর ভালো। যুবকের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

-কিছু বলবে কি?

-জ্বী। একটু সমস্যা। তবে……।

-সংকোচের কিছু নেই। বলে ফেলো।

বিয়ের কথা। তা-ও আবার নিজের। সংকোচ তো লাগবেই। এটা শুধু ওর নয়, সবার বেলায়ই এমন হয়। অবশ্য আধুনিক কালের ফ্যাশনী যুবক-যুবতীদের কথা ভিন্ন। বিয়ে কেন, আরো কয়েক ধাপ অগ্রসর হতেও তাদের কোনো লজ্জাবোধ হয় না।

যুবক লজ্জাবিজড়িত কণ্ঠে কাচুমাচু করে বলল, হুজুর! আমি একটি মেয়েকে বিয়ের জন্য নির্বাচন করেছি। মেয়ের বাড়ি কুফা নগরীতেই। ইতোমধ্যে বিয়ের আলোচনা অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু এক জায়গায় গিয়ে সবকিছু থমকে দাঁড়িয়েছে। এখন কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

এতটুকু বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল যুবক।

ইমাম সাহেব বললেন–থামলে কেন? বলো তোমার বিয়ের আলোচনা কোথায় গিয়ে, কেন থেমে গেছে।

যুবক বলল, হুজুর! দেনমোহর। এই দেনমোহরে গিয়েই বিলকুল থেমে গেছে আমার বিয়ের আলোচনা। কারণ মেয়ের বাবা এত বড় অঙ্কের মোহর দাবী করেছেন–যা আদায় করা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়।

-তাহলে অন্যত্র মেয়ে দেখো।

-আমার মন যে এখানেই বসে গেছে হুজুর।

-তাহলে তো মুশকিল!

-মুশকিল বলেই তো আপনার কাছে এসেছি। বসে আছি আপনার পরামর্শের অপেক্ষায়। মেহেরবানী করে আপনি একটি পথ বলে দিন।

-ঠিক আছে। আগে তুমি ইস্তেখারা করো।

-ইস্তেখারা!

-হ্যাঁ, ইস্তেখারা করে আমাকে ফলাফল জানিও। ইস্তেখারা করার নিয়ম জানো তো?

-নিয়মটা বলে দিলে ভালো হয়। তাছাড়া ইস্তেখারা জিনিসটা কি তাও….।

-তাও জানো না এই তো?

-ঠিক তাই।

-ইস্তেখারা হলো, একটি বিশেষ ধরনের আমলের নাম। যে সব ভালো কাজ করার জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে তুমি সরাসরি আদিষ্ট নও–যেমন, বিদেশ গমন, স্ত্রী নির্বাচন ইত্যাদি–যেসব ভালো কাজ করার পূর্বে, তা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে কি-না, উহা যাচাই করার জন্য যে বিশেষ আমল করা হয়–তা-ই ইস্তেখারা। এই আমলের নিয়ম–রাতে ঘুমানোর পূর্বে ইস্তেখারার নিয়তে দু’রাকাত নামাজ পড়বে এবং নামাজ শেষে একটি বিশেষ দোয়া পাঠ করবে। তারপর পবিত্র বিছানায় ঘুমাবে। ঘুম থেকে ওঠার পর তোমার মনটা যেদিকে স্থির হবে, সেটাই করবে। একদিনে মন স্থির না হলে পরপর কয়েকদিন করবে। ইস্তেখারা করলে, অনেক সময় স্বপ্নযোগে ভালো-মন্দ অবগত হওয়া যায়। তবে স্বপ্ন দেখা জরুরী নয়। এবার বুঝলে তো?

-জ্বী হুজুর বুঝেছি। এখন তাহলে যাই, ইস্তেখারা করে তারপর আসব।

-যাও।

যুবক চলে গেল। ইস্তেখারা করল। তারপর আবার এল ইমাম সাহেবের দরবারে।

ইমাম সাহেব দেখেই তাকে জিজ্ঞেস করলেন–

-কী খবর? ইস্তেখারা করেছ?

-জ্বী হুজুর করেছি।

-ফলাফল খুব ভালো।

-তাহলে ঐ মেয়েকেই বিয়ে করে নাও।

-মোহরের কী হবে হুজুর।

-ওরা যে পরিমাণ মোহর চায়, তা যে কোনো উপায়ে আদায় করে দাও। এরপর কি করতে হবে তা আমি দেখব।

-ঠিক আছে হুজুর তা-ই হবে।

এরপর বিয়ের তারিখ হলো। নির্ধারিত দিনে বিয়েও হলো। কিন্তু যুবক বেচারা অনেক চেষ্টা-তদবীর করেও মোহরের পূর্ণ টাকা সংগ্রহ করতে পারল না। তাই সে মেয়ে পক্ষকে বলল, এখন এই পরিমাণ মোহর নিন। বাকী টাকা কয়েকদিন পর পরিশোধ করে দিব।

মেয়ে পক্ষ কঠিন হৃদয়ের মানুষ। তারা বলল, মোহরের পূর্ণ টাকা আদায় না করা পর্যন্ত আমরা আমাদেরকে মেয়েকে বাসর ঘরে পাঠব না।

কী আশ্চর্য! সামান্য মোহরের কারণে যুবক তার প্রেয়সীর কাছে যেতে পারবে না!?

যুবক অস্থির, বেকারার। কিন্তু কী আর করা! বউ না দিলে তো জোর করে বউয়ের কাছে যাওয়া যায় না। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে আবার সে হাজির হলো ইমাম সাহেবের দরবারে। তারপর বর্ণনা দিল সবকিছুর।

ইমাম সাহেব বললেন–নগদ ঋণ করে পুরো মোহর আদায় করে দাও। বউ আয়ত্তে আনো। তারপর তাদের এই কঠোরতার মজা তারাই বুঝবে।  

-সে কিভাবে হুজুর?

-সময় হোক বলব।

ঋণ করে পুরো মোহর আদায় করল যুবক। তারপর বাসর হলো। পরদিন বউ নিয়ে নিজ বাড়িতে চলে এল। ওর আনন্দ দেখে মনে হলো, যেন পুরো পুরো পৃথিবীটাই এখন তার ঘরে!

সুন্দরী বউ পেয়ে যুবককে বেশ কয়েকদিন বাইরে তেমন একটা দেখা গেল না। প্রায় মাসখানেক অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সে ইমাম সাহেবের খেদমতে উপস্থিত হল। বলল–

-হুজুর! বউ তো পেলাম। কিন্তু ঋণ শোধাব কী করে?

-ঋণ শোধানোর বুদ্ধি আছে না?

-কী সেই বুদ্ধি?

বুদ্ধিটা হলো, তুমি তোমার শ্বশর পক্ষকে বলো–‘জীবিকা উপার্জনের জন্য আমি দূরের সফরে যাব। বউকেও নিয়ে যাব আমার সঙ্গে।’ একথা বললে এরা তোমার উপর কোনো অভিযোগ তুলতে পারবে না। কেননা আইনত তোমার বউকে তুমি যেখানে যাও সেখানে নেওয়ার অধিকার রাখো। সফরে যাবার তৈরি নাও। তারপর দেখো কী হয়।

বুদ্ধি নিয়ে বেচারা ঘরে ফিরে এল। বুদ্ধির প্রয়োগ করল। শ্বশুর পক্ষকে বলল, উপার্জনের জন্য আমি খোরাসান যাচ্ছি। স্ত্রীও আমার সঙ্গে যাবে।

একথা শুনে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বলল–কী? খোরাসান যাবে আমাদের মেয়েকে নিয়ে? বিশাল মরুপথ দিয়ে? পথে ডাকাতের ভয়!

এই মেয়েকে তারা সীমাহীন আদর করত। স্নেহ করত। সে ছিল সকলের নয়নের মনি। কলিজার টুকরো। সুতরাং পথের বিপদ-চিন্তা যতটা না তাদেরকে কষ্ট দিচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল, ওর বিচ্ছেদ-চিন্তা। তাদের থেকে ও দূরে চলে যাবে–এ ছিল তাদের নিকট বড় কষ্টের কারণ।

কিন্তু কি আর করা! স্বামী তার স্ত্রীকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে তাকে তো আর বাধা দেওয়া যায় না।

অবশেষে তারা পরামর্শে বসল। আলোচনা করল। মেয়েকে আটকে রাখার কোনো পথ কিংবা কৌশল খুঁজে পাওয়া যায় কি-না, সে ব্যাপারে অনেক মাথা খাটাল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।

সবশেষে ঠিক হলো, আচ্ছা আমাদের মাথায় যখন কিছু আসছে না, আমরা একটা কাজ করি। বিষয়টি ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর নিকট উপস্থাপন করে তার কাছে পরামর্শ চাই। তিনি তো মস্তবড় জ্ঞানী লোক। তার ইলম অপরিসীম। তিনি একটা পথ বলে দিতে পারবেন নিশ্চয়ই।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক সবাই হাজির হলো ইমাম সাহেবের খেদমতে। চোখে মুখে ভীষণ অস্থিরতা। সোনামুখ যেন শুকিয়ে শুটকি।

-কী হয়েছে আপনাদের? প্রশ্ন করলেন ইমাম সাহেব।

-ভীষণ বিপদ হুজুর!

-বলুন কী বিপদ আপনাদের।

তারা ধীরে ধীরে সবকিছুর বর্ণনা দিয়ে বিনয়ের সাথে বলল–এখন আমরা কি করব হুজুর? দয়া করে আমাদেরকে একটি পথ বাতলে দিন। আর যাই হোক মেয়ের বিচ্ছেদ আমরা কিছুতেই বরদাশত করতে পারব না।

ইমাম সাহেব বললেন–ইসলামী শরীয়ত স্বামীকে এই অধিকার দিয়েছে যে, সে সেখানে ইচ্ছা সেখানে তার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার আপনাদের নেই।

-জ্বী হুজুর। অধিকার তো নেই। কিন্তু মেয়েকে তো আমরা ছাড়তে পারছি না। ওর বিরহ-ব্যথা সইবার মতো শক্তি আমাদের নেই। ওকে ধরে রাখার মতো একটি পথ আপনি বের করে দিবেন–এজন্যেই তো আপনার খেদমতে আসা।

হ্যাঁ, পথ একটা আছে।

একথা শুনতেই তাদের মলিন চেহারাগুলো সজীব হয়ে ওঠল। বলল, পথটা কি? তাড়াতাড়ি বলে দিন হুজুর।

-পথটা তো খুব সহজ পথ। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে–আপনারা সেই পথে চলতে রাজী হবেন কি-না।

-কোনো ভয় নেই হুজুর। আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন। এই মেয়ের জন্য আমরা যে কোনো ধরনের কুরবানী দিতে প্রস্তুত।

-ছেলেকে সফরে না যাওয়ার ব্যাপারে রাজী করিয়ে নিন। আর রাজী করানোর সহজ পদ্ধতি হলো, আপনারা তার কাছ থেকে যা কিছু মোহর স্বরূপ গ্রহণ করেছেন, সব ফেরত দিন।

-ঠিক আছে হুজুর। আমরা তাই করব। তবু আমরা আমাদের মেয়েকে এত দূরের সফরে যেতে দেব না।

কথা মতো সমুদয় মোহর ফেরত দেওয়া হলো। ঐ অর্থ দিয়ে ঋণ শোধ করার পরও যুবকের হাতে অনেক টাকা রয়ে গেল। ইমাম সাহেবের বুদ্ধির জোরে ‘বউ এবং অর্থ’ দুটোই লাভ হলো। প্রিয় পাঠক! দেখলেন তো বুদ্ধির তেলেসমাতি! 

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, লেখকের বিয়ের গল্প টি পড়ে আপনার কাছে ভালো লাগলে লেখককে ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না। আপনাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লেখককে আরও সুন্দর ও ভালো লেখনির জন্য উদ্দীপনা যোগায়। – আমার বাংলা পোস্ট

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম (আদর্শ স্বামী স্ত্রী ১) 

এরপর পড়ুন : বংশের প্রভাব

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

1 thought on “বিয়ের গল্প : বুদ্ধির তেলেসমাতি”

Leave a Comment