কিন্তু এই কৃপণ মুনাফিকের স্ত্রী সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। একটি দিনও সে দান না করে থাকতে পারেনা। কম হোক, বেশি হোক–দান ওকে করতেই হবে। কোনোদিন কাউকে কিছু দিতে না পারলে ওর মোটেও ভালো লাগে না। আসলে মেয়েটির মধ্যে দানশীলতার এ প্রশংশনীয় গুনটি ছিল পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান। সে জানত যে, দান করলে মাল কমে না, বরং বাড়ে। তাই সে অকাতরে নিজের মাল থেকে গরীব-মিসকীন ও অসহায়-এতীমকে দান করত। তাছাড়া সে এও জানতে যে, তার মালের মধ্যে অন্যদের অধিকারও সংরক্ষিত আছে। দান সম্পর্কিত পবিত্র কুরআনের একখানা আয়াত সে মুখস্তই করে নিয়েছিল। যার অর্থ হলোঃ
“তাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের।” [সূরাঃ মাআরিজ, আয়াতঃ ২৪-২৫]
এদিকে কৃপণ লোকটি নিজে যেমন দু’পয়সা কাউকে দান করত না, স্ত্রীকেও তেমনি দান-খয়রাত করতে কঠোরভাবে বারণ করত। বলত, তুমি কাউকে কিছু দিতে না পারবে না। না টাকা পয়সা, না অন্য কিছু। যদি দাও, তবে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে তোমাকে। স্ত্রী বলত, আমি তো আপনার মাল থেকে দিচ্ছি না, বরং আমার মাল থেকেই দিচ্ছি; তথাপি আপনি আমাকে দান করতে নিষেধ করেন কেন? লোকটি তখন বলত, কেন-টেনো বুঝি না! তুমি দান করতে পারবে না, এ-ই হলো আমার শেষ কথা। নিজের মাল অন্যের হাতে তুলে দেওয়া–এ আমার একদম পছন্দ নয়।
স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও মেয়েটি গোপনে গোপনে দান করত। কারণ দান করা যার অভ্যাস; তদুপুরি দানের মহা ফজীলত ও উপকারিতার কথা যার জানা আছে–কীভাবে সে দান না করে থাকতে পারে? তাছাড়া সে জানে যে, স্বামীর ঐসব নির্দেশ–যা পালন করলে আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হয়–কখনোই তা পালন করা যাবে না। কেউ যদি পালন কর তাহলে সে গোনাহগার হবে।
অগোচরে স্ত্রী দান করে কি-না সেদিকে কৃপণ লোকটি যথেষ্ট খেয়াল রাখত। এমনকি এ কাজের জন্য গোয়েন্দা পর্যন্ত নিযুক্ত রাখত সে। তার স্পষ্ট বক্তব্য হলো, তার ঘর থেকে একটি পয়সাও বাইরে যেতে পারবে না। চাই দানকৃত পয়সার মালিক সে নিজে হোক বা অন্য কেউ। যদি কখনো তার নজরে ধরা পড়ত যে, স্ত্রী কাউকে কিছু দান করেছে, তখনই সে স্ত্রীকে শাসাত। এমনকি মারধর পর্যন্ত করত। কিন্তু তার স্ত্রী আগের মতোই দান-খয়রাতকরে যেত। স্বামীর শাসন কিংবা তার তার রক্তচক্ষু কোনো কিছুই তাকে একাজ থেকে বিরত রাখতে পারত না।
এভাবে অনেকদিন চলার পর কৃপণ লোকটি তার স্ত্রীকে যখন দান করা থেকে বিরত রাখতে পারল না, তখন একদিন সে রাগের মাথায় কসম করে বলল, তুমি যদি আর দান-খয়রাত করো তাহলে তোমাকে তালাক দিয়ে দেব।
পরের দিন কৃপণের স্ত্রী ঘরে কাজ করছিল। এমন সময় ঘরের দরজায় এসে একজন মিসকীন হাঁক ছেড়ে বলল, হে গৃহবাসী! আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দান করো।
মিসকীনের ডাক শুনে কৃপণের স্ত্রী তাকে তিনটি রুটি দান করল। রুটি পেয়ে মিসকীন চলে যাচ্ছিল। এমন সময় সেই কৃপণ লোকটি মিসকীনের হাতে রুটি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই রুটি কোত্থেকে পেলে?
মিসকীন লোকটি বলল, অমুক ঘর থেকে পেয়েছি।
কৃপণ লোকটি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বাড়িতে গেল। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি তোমাকে কসম দিয়ে বলিনি যে, দান খয়রাত করলে তোমাকে তালাক দিয়ে দেব?
স্ত্রী বলল, আমি আল্লাহর নামে দান করেছি। মিসকীন লোকটি যখন আল্লাহর নামে আমার কাছে কিছু চাইল, তখন আমি তাকে না দিয়ে পারিনি।
কৃপণ লোকটি বলল, ঠিক আছে তোমাকে এর মজা দেখাচ্ছি। এ বলে সে বাইরে গিয়ে বড় একটি অগ্নিকুঞ্জ প্রজ্জ্বলিত করল। তারপর স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি তো আল্লাহর নামে দান করেছ; এবার আল্লাহর নামে এই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দাও তো দেখি!
নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দানশীলা এই নারী দেরী করল না। সে তাড়াতাড়ি গহনা-অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে এল। এ সময় কৃপণ মুনাফিক বলল, তুমি গহনা খুলে ফেলো। তারপর আগুনে ঝাঁপ দাও।
স্ত্রী বলল, বন্ধু তো বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করার সময় সজ্জিত হয়েই সাক্ষাৎ করতে যায়। আমি তো এখন আমার প্রিয় বন্ধু আল্লাহর সাক্ষাত লাভে জন্য ধন্য হতে যাচ্ছি। এতটুকু বলেই সে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে স্ত্রী যখন আগুনের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন মুনাফিক লোকটি ভাবল, সে তো এখন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। তাই আগুনের গর্তটি উপর দিয়ে ঢেকে সে আপন কাজে চলে গেল।
এ ঘটনার পর এক সফরে বেশ দূরে চলে গিয়েছিল কৃপণ লোকটি। তিনদিন পর সে ফিরে এল। তারপর গর্তের ঢাকনা খুলে দেখল, তার স্ত্রী দিব্যি-সালামতে আছে। তার শরীরের একটি পশমও পুড়েনি। এ দৃশ্য দেখে সে বিস্ময়ে হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল, এও কি সম্ভব! এমন সময় অদৃশ্য থেকে একটি আওয়াজ এলো, ‘ওহে! তুমি কি একথা বিশ্বাস করো না যে, অগ্নি আমার প্রিয়জনকে কখনো স্পর্শ করে না?”
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! দেখলেন? মহান আল্লাহ পাক আল্লাহ পাক দানের ওসিলায় মুনাফিক লোকটির স্ত্রীকে কতবড় কঠিন অবস্থায় হেফাযত করেছেন? কিভাবে তাকে সহী-সালামতে রেখেছেন? হ্যাঁ, দান-খয়রাত সত্যি এক মহাশক্তিধর জিনিস। এর বদৌলতে আল্লাহ পাক মানুষেকে কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদ থেকেও বাঁচিয়ে দিতে পারেন। হেফাযত করতে পারেন নানাবিধ পেরেশানী থেকে। তবে সে দান অবশ্যই নিষ্ঠার সাথে হতে হবে–হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই।
এখানে আরেকটি কথা হলো, যে দানের ওসিলায় মহান রাব্বুল আলামীন বনী আদমকে দুনিয়ারব বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করেন, যে দানের বদৌলতে আল্লাহ পাক পরকালের কঠিন শাস্তি থেকেও আমাদেরকে হেফাযতে রাখবেন–এ আশা কি আমরা করতে পারি না? হ্যাঁ, পারি। অবশ্যই পারি।
তাই আসুন, আজ থেকে আমরা কৃপণতার স্বভাব পরিত্যাগ করে আল্লাহর পথে বেশি বেশি দান-সদকা করি। এতিম-অসহায় ও বঞ্চিত মানুষগুলোকে দূর দূর করে তাড়িয়ে না দিয়ে নিজের ভাই-বোনের মতোই স্নেহের ছায়া দান করি। আদর-যত্ন করি। সামর্থ অনুসারে দান করি। আর মনে রাখি-এসব মানুষকেই আল্লাহ পাকই অভাবি বানিয়েছেন; তিনি ইচ্ছা করলে আমাদেরকেও এমন বানাতে পারেন। তাই আল্লাহর কাছে আমাদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত। হে করুণার আধার দয়ালু মাওলা! তুমি আমাদের অকাতরে দান করার তাওফিক দাও। তাওফিক দাও–তোমার দেওয়া নেয়ামতের যথাযথ শুকরিয়া আদায় করার। আমীন!!
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম
এরপর পড়ুন : যতো পারো কথা বলো
For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.