প্রিয়তমা : প্রিয়তমাকে হৃদয়স্পর্শী চিঠি!

প্রিয়তমা - হৃদয়স্পর্শী চিঠিগাজী আনোয়ার পাশা। তুর্কী বীর মুজাহিদদের একজন। যিনি আজীবন ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রম যুদ্ধ করেন এবং অবশেষে রাশিয়ার বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত জিহাদে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন।

এই মর্দে মুজাহিদ শাহাদাতের মাত্র একদিন পূর্বে প্রিয়তমা স্ত্রী নাজিয়া সুলতানার নামে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। এই চিঠিখানা একদিকে যেম্মন হৃদয়স্পর্শী ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী তেমনি দারুণ শিক্ষাণীয়ও বটে। আমার বিশ্বাস, যে কোনো মুসলমান নর-নারী বিশেষ করে তরুণ-নওজোয়ানদের ঈমানী চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

উল্লেখ্য যে, মর্মস্পর্শী এই চিঠিখানা প্রথমে তুরস্কের সংবাদপত্রে এবং পরে ১৯২৩ খৃস্টাব্দে তৎকালীন ভারত বর্ষের একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। চিঠিখানা নিম্নরূপঃ

আমার জীবন সঙ্গিনী! আমার সুখ ও স্বপ্নের ঠিকানা! প্রাণপণা নাজিয়া! মহান আল্লাহ তাআলা তোমার হিফাযতকারী। তোমার লিখা সর্বশেষ পত্রটি এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে । তোমার এই চিঠি আমার অন্তরে গেঁথে থাকবে আজীবন। তোমার মায়াবী চেহারা আজ আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তোমার হাতের লেখা পত্রটির প্রতিটি লাইনে লাইনে অক্ষরে অক্ষরে দৃষ্টিপাত করলেই তোমার আঙ্গুলগুলো নড়াচড়ার দৃশ্য আমার দু’নয়নে ভেসে উঠে;

যেগুলো একসময় আমার চুল নিয়ে খেলা করত। তাবুঘেরা এই মেঘলা পরিবেশেও ক্ষণে ক্ষণে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তোমার প্রিয় মুখ।

হায়! তুমি কি লিখেছ, আমি কিনা তোমায় ভুলে বসে আছি। তোমার ভালোবাসার কোনো মূল্য দিইনি। তুমি বলেছ, আমি তোমার প্রেমভরা হৃদয়কে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দূর দেশে আগুন আর রক্ত নিয়ে খেলা করছি।

আমি মোটেও ভাবছি না যে, একজন হতভাগা নারী নিস্তব্ধ রজনীতে আমার বিরহের বেদনায় অস্থির হয়ে আছে, আর আকাশের তারা গুনছে। তুমি আরও বলেছ যে, আমি নিছক তরবারীর প্রতিই আসক্ত ও অনুরক্ত!

প্রিয়তমা! এ কথাগুলো লিখার সময় তুমি হয়তো ভেবেও দেখনি যে, তোমার এ শব্দগুচ্ছ যা তুমি নিঃসন্দেহে অকৃত্রিম ও খাঁটি ভালোবাসার টানে লিখেছ, আমার অন্তরকে কী বীভৎসভাবে রক্তাক্ত করে দিবে। আমি তোমাকে কি করে বুঝাবো যে, এ পৃথিবীতে তোমার ভালোবাসাই আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তুমিই আমার সকল ভালোবাসার শুরু ও শেষ। তুমিই আমার সকল ভালোবাসার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। ইতোপূর্বে আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি। তুমি, হ্যাঁ একমাত্র তুমিই আমার অন্তরকে ছিনিয়ে নিয়েছ। জয় করেছ আমার হৃদয়রাজ্য।

তবু আক কেন আমি এতদূরে? কেন তোমার থেকে বিছিন্ন হয়ে আছি? হে প্রাণপ্রিয়া!

এ প্রশ্ন তুমি অবশ্যই করতে পারো। তাহলে শোনো, ধন-সম্পদের মোহে আমি তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ক্ষমতার লালসা কিংবা মসনদ লাভের আশায়ও আমি আজ দূরে নই। যেমনটি শুত্রুরা আজ আমার নামে রুটিয়েছে। আমি বরং আল্লাহ তাআলার পক্ষে অর্পিত কর্তব্যের টানেই তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। তুমি হয়তো জানো যে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে বড় কোনো ফরয বা কর্তব্য হতে পারে না। এটি এমনই মহিমাময় ফরয, যার প্রতিজ্ঞা করলেই মানুষ জান্নাতুল ফিরদাউসের উপযুক্ত হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ! আমি কেবল প্রতিজ্ঞাতেই সীমাবদ্ধ থাকিনি, বরং নিখুঁত বাস্তবতায় তা পরিণতও করেছি।

প্রিয়তমা! তোমার বিয়োগ-যন্ত্রণা সদ্য শাণিত তরবারী দিয়ে আঘাত করার মতো যা আমার হৃদয়কে প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত করে। কিন্তু এই বিয়োগ-যন্ত্রণাতেও আমি অত্যন্ত আনন্দিত, দারুণ তৃপ্ত। কেননা শুধু তোমার ভালোবাসাই আমার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় এক চ্যালেঞ্জ ছইল। ছিল এক মহা পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলার দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া,

এই পরীক্ষায় আমি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং আল্লাহ তাআলার মহব্বত ও নির্দেশকে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদার উপর প্রাধান্য দেওয়ার পরীক্ষায় সফল হয়েছি। এজন্য অবশ্য তোমারও আনন্দিত হওয়া উচিৎ একথা ভেবে যে, তোমার জীবন সঙ্গিনী টি ঈমান অত্যন্ত দৃঢ় ও মজবুত। যার কারণে তিনি আল্লাহর ভালোবাসাকে রক্ষা করতে গিয়ে তোমার ভালোবাসাকে অবলীলায় বলি দিতে পেরেছেন।

ওগো প্রিয়তমা! তোমার উপর তরবারীর জিহাদ ফরয নয়। তবে তুমি জিহাদের বিধানের বাইরে নও। নারী কিংবা পুরুষ কোনো মুসলমানই জিহাদের বিধানের বাইরে নয়।

তোমার জিহাদ হলো, তুমিও নিজের চাহিদা ও ভালোবাসাকে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার উপর প্রধান্য দিবে।স্বামীর সঙ্গে গভীর আন্তরিক ভালোবাসাকে আরও প্রগাঢ় করবে।  

স্মরণ রাখবে, এই কামনা কখনোই করবে না যে, তোমার স্বামী জিহাদের ময়দান হতে অক্ষত অবস্থায় তোমার ভালোবাসা ও আদরের কোলে ফিরে আসুক। কারণ এরূপ কামনা হবে স্বীয় স্বার্থের জন্য, যা আল্লাহর নিকট অপছন্দনিয়। সর্বক্ষণ দোয়া করবে, যেন আল্লাহ তাআলা তোমার স্বামীর জিহাদকে কবুল করেন। তাকে হয়তো বিজয় বেশে ফিরিয়ে আনুক,

নতুবা শাহাদাতের অমীয় সুধাপানে ধন্য করুক। তুমি জানো, আমার এ ঠোঁট কখনো নাপাক মদ স্পর্শ করেনি। বরং এই ঠোঁট সর্বদাই আল্লাহর তিলাওয়াতে মশগুল থাকে।

 প্রিয়তমা! আহ! সে মুহূর্তটি কতই না মোবারক ও মহিমাময় হবে, যখন আমার দেহ থেকে শির বিচ্চিন্ন হয়ে যাবে। যাকে তুমি অত্যন্ত চমৎকার বলতে! যা তোমার দৃষ্টিতে কোনো যোদ্ধার দেহ ছিল না, ছিল একজন লাবণ্যময় প্রিয়দর্শী পুরুষের দেহ।

এ মুহূর্তে আমার সবচেয়ে প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা হলো শহীদ হওয়া। হুযরত খালেদ বিল ওয়ালিদ রাযি, এর সঙ্গে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হওয়া। এ দুনিয়ার তৃপ্তি ও প্রাপ্তি যেহেতু ক্ষণস্থায়ী, তাই মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কী অর্থ?

মৃত্যু যখন সুনিশ্চিত, তবে বিছানায় শুয়ে মরব কেন? তদুপরি শাহাদাতের মৃত্যু তো মৃত্যু নয়; বরং প্রকৃত বেঁচে থাকা। অনন্তকালের জন্য।

নাজিয়া! তোমার প্রতি আমার প্রথম অসীয়ত-আমি শহীদ হয়ে গেলে তোমার দেবর আমার ছোটভাই নূরী পাশার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। আমার চোখে, তোমার পরে আমার সর্বাধিক প্রিয়পাত্র হলো নূরী। আমি চাই, আমার আখেরাতের যাত্রার পর থেকে নিয়ে আজীবন সে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তোমার খেদমত করুক।

আমার দ্বিতীয় অসীয়ত হলো, তোমার যত সন্তান হবে, তাদের সকলকে আমার জীবনেতিহাস শুনাবে। ইসলাম  ও দেশপ্রেমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। এবং আল্লাহর রাস্তায় পাঠিয়ে দেবে। যদি তুমি আমার এ অসীয়তকে রক্ষা না করো, তবে মনে রেখো, জান্নাতে আমি তোমার থেকে আলাদা হয়ে থাকব।

আমার তৃতীয় অসীয়ত হলো, মোস্তফা কামাল পাশার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করবে। সাধ্যমত তার সাহায্য করবে। কেননা এমুহূর্তে মহান আল্লাহ তাআলা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অর্জন তার উপরই নির্ভরশীল রেখেছেন।

প্রিয়া! এবার তাহলে বিদায়। কেন যেন আমার মন বলছে, এ চিঠিই তোমার প্রতি আমার শেষ চিঠি। এরপর আর কখনো কোনো চিঠি লিখার সুযোগ হবে না। কী আশ্চর্য! হয়তোবা আগামীকালই আমি শহীদ হয়ে যাবো। দেখ, ধৈর্য হারাবে না। আমার শাহাদাতের পর ব্যাকুল ও পেরেশান হওয়ার স্থুলে খুশি ও আনন্দিত হবে। এজন্য যে, আল্লাহ তাআলা তার রাস্তায় আমাকে কবুল করেছেন। এটা তোমার জন্য গৌরবের বিষয়।

নাজিয়া! এখন বিদায় নিচ্ছি। আমার কল্পনা ও স্বপ্নের জগতে তোমাকে আলিঙ্গন করছি। ইনশাআল্লাহ জান্নাতে দেখা হবে। তারপর আর কখনো বিছিন্ন হবো না।

উল্লেখ্য যে, এ পত্র লিখার সময় মোস্তফা কামাল পাশা শুধু ইসলামের একজন সাধারণ মুজাহিদ হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তখনো তিনি তুরস্কের ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে সে সকল পদক্ষেপ গ্রহন করেননি যা তাকে পরবর্তীতে জগদ্বিখ্যাত প্রবাদপুরুষে পরিণত করেছিল।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! গাজী আনোয়ার পাশা প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নাজিয়ার কাছে লেখা জীবনের শেষ চিঠিতে একজন প্রকৃত মুমিন ও আদর্শ স্বামীর সুন্দর একটি চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত আগত প্রতিটি স্বামীকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, একজন খাঁটি মুমিন কখনোই আল্লাহর ভালোবাসার সামনে অন্য কোনো ভালোবাসাকে প্রধান্য দিতে পারে না।এমনকি স্ত্রীর ভালোবাসাকে না।  দোয়া করি, মুসলমানদের এই দুর্দিনে ও চরম দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে গাজী আনোয়ার পাশার মতো ঈমানী জযবা ও অবিচল হিম্মত প্রতিটি স্বামীকে আল্লাহ পাক নসীব করুন। আমীন  [সূত্রঃ তারকানে আহরান]

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম (আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২)

এরপর পড়ুনঃ প্রিয়তমার সাথে কিছুক্ষণ

প্রিয় পাঠক পাঠিকা, মুজাহিদ গাজী আনোয়ার পাশা তাঁর প্রিয়তমা কে লেখিত হৃদয়স্পর্শি চিঠিটি পড়ে ভালো লাগলে এটি শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। হৃদয় ছোঁয়া গল্প পড়তে প্রতিদিন আমার বাংলা পোস্ট.কম এ আসুন। 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment

Discover more from Amar Bangla Post

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading