লেখকের বুদ্ধিমতি নারীর প্রজ্ঞাপূর্ণ জিজ্ঞাসা গল্পটি পড়ে অনেক বোনেরা নিজেদের স্বামীর দাসী মনে করতে পারেন। তবে যেসব বোনেরা স্বামীর সেবায় নিজেকে উড়ার করে দিয়ে স্বামীন হৃদয় রাজ্য করার মাধ্যমে জান্নাত লাভের উপায় পেতে চায়, সেসকল বোনেরা লেখকের এই “স্বামীর সেবার পরামর্শগুলি” হৃদয়াঙ্গম করতে পারেন। সম্মানিত লেখক একটি হাদিসের উদ্বৃতি দিয়ে স্বামীর সেবার পরামর্শগুলি তুলে ধরেছেন। তাহলে চলুন স্বামীকে সেবার করার নিয়মাবলি জানা শুরু করা যাক:
বুদ্ধিমতি নারীর প্রজ্ঞাপূর্ণ জিজ্ঞাসা (স্বামী ভক্তির গল্প)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষ উভয়েরই নবী। তিনি জগতের শ্রেষ্ঠ মানব। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। বিশ্ব মানবতার মুক্তিই ছিল তার জিন্দেগীর একমাত্র মিশন। তিনি ছিলেন দয়ার আধার, রাহমাতুল্লিল আলামীন। বঞ্চিত, নিপীড়িত ও দুর্বল মানুষকে তিনি অতি ভালবাসতেন। যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত, অবহেলিত নারী জাতিকে তিনিই মহাসম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। নির্যাতিতা, অত্যাচারিতা নারী সমাজকে অবমাননার অতল গহ্বর থেকে টেনে তুলেছেন । মুক্তি দিয়েছেন বঞ্চনা ও পশুত্বের বন্দীদশা থেকে ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের মহিলারা ছিলেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। তাদের মনে যে কোন প্ৰশ্ন দেখা দিলে তৎক্ষণাত তা জানার জন্য রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতেন। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের প্রশ্নগুলো মনযোগ সহকারে শ্রবন করে এগুলোর সন্তোষজনক জবাব দিতেন ।
একদিনের ঘটনা।
হযরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ আনসারী (রা.) এর মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দিল। অনেক চেষ্টা করেও তিনি এর সমাধান খোঁজে পেলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। অতঃপর অনুমতি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বললেন-
ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মাতা-পিতা আপনার উপর কুরবান হউক । মুসলিম নারীদের প্রতিনিধি হয়ে আমি আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই আল্লাহপাক নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য আপনাকে নবী করে পাঠিয়েছেন। তাই আমরা নারী মহলও আপনার উপর এবং আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আশা করি এর সন্তোষজনক জবাব দিয়ে আমাদের সকল নারীকে ধন্য করবেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি নিঃসংকোচে তোমার প্রশ্ন বিবৃত কর। হযরত আসমা (রা.) বললেন, আমার প্রশ্ন হল, আমরা ঘরের কোণে পর্দার অন্তরালে থেকে শুধু পুরুষদের আশা- আকাংখা ও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে থাকি। তাদের সন্তানদের আমরাই গর্ভে ধারণ করি। এতদ্বসত্ত্বেও পুরুষগণ অনেক ব্যাপারে পূণ্য প্রাপ্তির দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অগ্রগামী থাকে। যেমন-তারা জুমআর নামাযে শরীক হয়, জামাতে নামায পড়ে, রোগী দেখাশুনা করে, হজ্বের পর হজ্জ করে, সর্বোপরি তারা জিহাদে শরীক হয় ৷
আর তারা যখন হজ্ব, ওমরা, জিহাদ ইত্যাদিতে গমন করে তখন আমরা তাদের জন্য কাপড় বুনে থাকি । এখন আমার জিজ্ঞাসা হল, আমরা কি ছাওয়াবের বেলায় পুরুষদের সমান অংশীদার হতে পারি না?
হযরত আসমা (রা.) এর বক্তব্য শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী চেহারা খুশিতে ঝলকিত হয়ে উঠল। তার গোটা মুখ মন্ডলে একটা স্নিগ্ধ হাসির বিদ্যুত চমক খেলে গেল । হৃদয় কাননে সঞ্চারিত হল উৎফুল্লতায় ভরা গভীর প্রশান্তি ।
তিনি সাহাবায়ে কেরামের দিকে মুখ ফিরে তাকালেন। বললেন, হে আমার সাহাবারা। ধর্মের ব্যাপারে এ মহিলার চেয়ে উত্তম প্রশ্নকারী তোমরা দেখেছ কি?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, মেয়েরা যে এত বুদ্ধিমতী হয় এবং তারা যে এত সুন্দর ও প্রজ্ঞাপূর্ণ প্রশ্ন করতে পারে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।
অতঃপর নবীকুল শিরোমনি, সারওয়ারে দু’আলম মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আসমা (রা.) কে লক্ষ্য করে বললেন-
আসমা! মনযোগ দিয়ে শুন। উত্তম রূপে বুঝে লও। আর তুমি যেসব মেয়েদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছ, তাদেরকে বলে দিও-স্বামীর খেদমত করা এবং তার সন্তুষ্টি তালাশ করা উল্লেখিত সমস্ত সাওয়াবেরই সমতুল্য। একথা শুনে হযরত আসমা (রা.) অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বাড়ী ফিরে এলেন।
সম্মানিত মা ও বোনেরা! দেখলেন তো, দয়ার সাগর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাদের জন্য রাস্তা কত সহজ করে দিয়েছেন! আপনারা জুমআ, জামাত, জানাযা ইত্যাদিতে শরীক না হয়েও এমনকি জিহাদের মত কঠিন বিধান যাতে যেখানে যে কোন মুহূর্তে চিরকালের জন্য জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে, সেই জিহাদে অংশ গ্রহণ না করেও আপনারা পুরুষদের সমান ছাওয়াব ও মর্যাদা লাভ করতে পারেন। তবে এজন্য শর্ত হল, স্বামীর সেবা ও তাদের মানসা মোতাবেক জীবন যাপন করা। এ সামান্য একটু কাজ করতে পারলেই আপনার বিনা পরিশ্রমে লক্ষ কোটি ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবেন। আপনাদের মর্যাদা উঁচু থেকে উঁচুতর হতে থাকবে। বস্তুতঃ মেয়েদের জন্য স্বামীর সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং তাদের অনুগত থাকা একটি অমূল্য সম্পদ।
একদা সাহাবায়ে কেরাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! অনারব লোকেরা আপন আপন রাজা-বাদশাহকে সিজদা করতঃ সম্মান প্রদর্শন করে। অথচ সিজদা পাওয়ার আপনিই বেশী উপযোগী ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দেখ! সিজদা পাওয়ার উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই । যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার আদেশ আমি দিতাম তবে নারীদের বলতাম, তারা যেন নিজ নিজ স্বামীকে সিজদা করে। সেই কুদরতী খোদার কসম করে বলছি, যার হাতে আমার জান, যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা আপন স্বামীর হক আদায় না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহর হক আদায় করতে পারবে না ।
অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি স্বামীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ভিন্ন বিছানায় রাত কাটায় তবে ফেরেশতারা তার উপর অভিসম্পাত করতে থাকে। অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দু’ব্যক্তির নামায কবুলিয়্যাতের জন্য মাথার উপরও উঠতে পারে না। এক, মনিব থেকে পলায়নরত গোলাম । দুই, স্বামীর অবাধ্য স্ত্রী।
মুহতারাম পাঠক-পাঠিকা! দাম্পত্য জীবনের দুই অভিযাত্রীর একজন স্বামী অপরজন স্ত্রী। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় এ জোড়ার সৃষ্টি, বিকাশ ও সংযোগ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন, আমি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা তাদের নিকট স্বস্তি খোঁজে পাও। আর তোমাদের মাঝে সৃষ্টি হয় আকর্ষণ, ভালবাসা ও বন্ধুত্ব। (সুরা রোম : ২১)
দাম্পত্য জীবনের এই আকর্ষণ, ভালবাসা ও বন্ধুত্ব নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাকের দান। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা বন্ধনটিকে দিক নির্দেশনাহীন ছেড়ে দেয়া হয়নি। এর জন্য দেয়া হয়েছে উৎকৃষ্ট মানের নির্দেশনা, আচার-অনুষ্ঠান ও বিধি নিষেধ। এসব নিয়ম-নীতি পালন করলে শুধু যে দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়ে উঠবে তাই নয়, বরং মানব সভ্যতার কেন্দ্র বিন্দুরূপে পরিবারে অনাবিল প্রশান্তি নেমে আসায় গোটা বিশ্ব জগত পরিণত হবে শান্তি ও সুখের নীড়ে।
একটি নারী হাতে মেহেদী মেখে একজন অজানা-অচেনা পুরুষকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেয়। সবচেয়ে বেশী আপন মনে করে চলে আসে স্বামীর ঘরে। স্বামীর ঘরকেই মনে করে নিজের আপন ভূবন। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেয় স্বামীর কাছে। তাকেই বানায় সকল চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু। স্বামীর আদর যত্ন সোহাগে স্ত্রীর জীবন হয় ধন্য। যারা স্বামীর এ আদর সোহাগ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হন, তাদের জীবনে নেমে আসে চরম অন্ধকার। জীবন হয়ে উঠে দুর্বিসহ। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবন যাপন ।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, এ ভালবাসা কেউ কারও কাছ থেকে জোর করে আদায় করতে পারে না। সেটা তাকে জয় করে নিতে হয়। আর তা জয় করা যায় কেবল ভালবাসা দিয়েই। অন্য কিছু দিয়ে নয়। যে যত ভালবাসা দিতে পারে, সে তত ভালবাসা পেতে পারে। যারা অপরকে ভালবাসা দিতে পারে না, তাদের ভালবাসা পাওয়ারও কোন অধিকার নেই ।
আরও পড়তে পারেন : স্বামীর মন জয় করার এক মর্মস্পর্শী কাহিনী | Bangla Lifestory
দাম্পত্য জীবনে প্রকৃত প্রেম ও নিখাদ ভালবাসার রূপ রেখা কেমন হবে, নিম্নোক্ত দিক নির্দেশনাগুলো মনযোগ সহকারে পাঠ করলেই পাঠক-পাঠিকার নিকট তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আশা রাখি। এ দিক নির্দেশনাগুলো ঐসব মা-বোনদের উদ্দেশ্যে লিখে দিলাম, যারা সত্যিকার অর্থেই প্রিয়তম স্বামীর সন্তুষ্টি লাভে গভীর ভাবে আগ্রহী; যাদের মনে এ চিরন্তন সত্য কথাটি বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, স্বামীকে খুশি রাখাই স্ত্রীর জীবনের প্রধান কাজ। তাকে খুশি রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারলেই তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত। এক কথায় স্বামীর ভালবাসা পেতে হলে এবং সুখী দাম্পত্য জীবন গঠন করে উভয় জাহানে সফলতা অর্জন করতে চাইলে একজন নারীকে অবশ্যই নিম্নের বিষয়গুলো মেনে চলা অপরিহার্য। অন্যথায় দাম্পত্য জীবন দুনিয়াতেই জাহান্নাম সদৃশ হতে বাধ্য। বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
এক. হাসি মাখা মুখ নিয়ে সেজেগুজে থাকুন : আল্লাহপাক পুরুষ জাতিকে বিভিন্ন রুচি ও মন-মানসিকতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তবে কিছু কিছু জিনিষ এমন আছে যা সব ধরণের পুরুষের কেবল পছন্দনীয়ই নয়, হৃদয়ের ঐকান্তিক কামনাও বটে। তন্মধ্যে একটি হল, স্ত্রীর সাজসজ্জা ও হাসিমাখা মুখ। আর এটি স্ত্রী জাতির এমন এক প্রশংসনীয় গুণ, যদ্বারা অল্পদিনের মধ্যেই স্ত্রী তার স্বামীকে বশে আনতে সক্ষম। কোন স্ত্রী যদি সর্বদা না পারলেও, শুধু স্বামীর উপস্থিতির সময়টুকুতে হাস্যোজ্বল চেহারা নিয়ে সেজেগুজে আকর্ষণীয় হয়ে থাকতে পারে তাহলে তার স্বামী যত খারাপই হোক না কেন, একদিন না একদিন তার হৃদয়ে স্বীয় স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালবাসা জন্ম নেবেই । আর স্বামী যদি পূর্ব থেকেই সচ্চরিত্রবান হয়ে থাকেন তবে তো সোনায় সোহাগা। কেননা এরূপ স্বামী তখন স্ত্রীকে শতগুণে বেশী ভালবাসবে, মুহব্বত করবে। এটি বহু পরীক্ষিত বাস্তব সত্য কথা।
সুতরাং সচেতন মুসলিম মা বোনদের নিকট সবিনয় আরজ করছি আপনারা যারা স্বামীকে সীমাহীন পর্যায়ের খুশি করতে চান কিংবা স্বামীর ব্যাপারে এ ধরণের অভিযোগ করেন যে…
(১) তিনি আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন না।
(২) আমার খোঁজ-খবর নেন না।
(৩) আমার কথার কোন মূল্যায়ন করেন না।
(৪) আমাকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেন ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন।
(৫) শ্বাশুরী ও ননদের পরামর্শ অনুযায়ী চলেন।
(৬) তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
(৭) আমার সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখেন না।
(৮) অফিস বা দোকান থেকে ফিরেই সামান্য থেকে সামান্য বিষয় নিয়ে ধমকাতে থাকেন অথবা স্বামীর ব্যাপারে আপনার যদি এ ধরণের মারাত্মক অভিযোগও থাকে যে, তিনি অন্য নারীর প্রতি আসক্ত, তার সাথে সময় কাটায়, ফস্টি-নষ্টি করে, কথা-বার্তা বলে ইত্যাদি! তাহলে আজ থেকেই আপনারা উপরে বর্ণিত পদ্ধতিটি অবলম্বন করতে শুরু করুন।
অর্থাৎ কমপক্ষে ততক্ষণ পর্যন্ত সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকুন যতক্ষণ স্বামী ঘরে থাকে। যদি জানা থাকে যে, তিনি দিবা-রাত্রির এ সময়টিতে বাসায় ফিরেন, তবে এ সময় আসার সামান্য পূর্বেই হাতের কাজ রেখে দিন। অতঃপর হাত মুখ ধুয়ে মিছওয়াক করে বা প্রয়োজনে গোসল সেরে ঘরে রক্ষিত সাজ-সজ্জার যাই আছে, তা দিয়েই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তুলুন । আল্লাহ তাআলা আপন মেহেরবাণী দ্বারা আপনাকে যতটুকু রূপ সৌন্দর্য দান করেছেন, তার শুকরিয়া আদায় করত বৈধ সাজ-সজ্জার মাধ্যমে স্বামীকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হউন । আমি জোর দিয়েই বলতে পারি, আপনি সুন্দর, শ্যামলা, কালো যাই হোন না কেন আপনার দৈহিক অবয়ব যেমনই হোক না কেন, যদি আপনি হৃদয় নিংড়ানো সমস্ত ভালবাসাকে একত্রিত করে স্বামীকে আনন্দ দানের খালেছ নিয়ত নিয়ে সাজতে পারেন, আর ঘরে অন্য কেউ না থাকলে ভূবন মোহিনী একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে তাকে স্বাগত জানাতে পারেন তারপর কয়েক মিনিট স্বামী স্ত্রী সুলভ আচরণ সেরে তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন- ও আমার হৃদয়ের স্পন্দন, চোখের জ্যোতি! কেমন আছেন আপনি? বাসায় ফিরতে কোন অসুবিধা হয়নি তো? দুপুরে কি খেয়েছেন? বাসে সীট পেয়েছিলেন তো? ইত্যাদি তাহলে দেখবেন অল্প দিনের মধ্যেই আপনার সকল অভিযোগ তুলোর মত বাতাসে উড়ে গেছে। এবার আপনি অভিযোগ করবেন দূরের কথা তার প্রশংসা করেও শেষ করতে পারবেন না ।
আপনি মুখে স্নো-পাউডার ও অন্যান্য বৈধ প্রসাধনী ব্যবহার করুন। স্বামী লিপিস্টিক মাখা ঠোঁট দেখতে ভালবাসলে, যে রংটি তার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়, তা দিয়েই অধরগুলোকে রাঙ্গিয়ে তুলুন। চোখে সুরমা ব্যবহার করুন। হযরত আবুল আসআদ (রা.) একদা আপন কন্যাকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, স্বামীর জন্য সাজ সজ্জা ও রূপচর্চার প্রতি লক্ষ্য রাখবে। চোখে সুরমা ব্যবহার করবে। কারণ চক্ষুযুগলের শ্রীবৃদ্ধিকারী সর্বোত্তম প্রসাধনী হল সুরমা। আর নিয়মিত সুগন্ধি ব্যবহার করবে। মনে রেখ, সর্বাপেক্ষা উত্তম সুগন্ধি হল উত্তমরুপে অজু করা।
ইউরোপের জনৈকা সুন্দরী তার সমবয়স্কা তরুণীদেরকে প্রতিদিন কয়েকবার ঠান্ডা পানি দ্বারা চেহারা ধৌত করতে গুরুত্বারোপ করত । এতে বুঝা গেল, ঠান্ডা পানি মেয়েদের কোমল চেহারার জন্য অত্যন্ত উপযোগী বস্তু ।
আপনি আপনার প্রাণোচ্ছল হাসিকে কেবল স্বাগত জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন না। বরং স্বামী যতক্ষণ ঘরে থাকবেন ততক্ষণ তার সাথে হাসি-মুখে কথা বলুন। আপনার হাসি মাখা, আনন্দভরা মুখাবয়ব স্বামীর অসংখ্য দুঃখ বেদনা দূর করতে পারে। চিন্তা-ফিকির, ক্লান্তি ও পেরেশানীকে দূর করে তাকে সুখ-সমৃদ্ধি, শক্তি সাহস ও সজীবতা দান করতে পারে।
শরীয়ত সম্মত এমন সব কাপড়-চোপড় এমনভাবে ব্যবহার করুন যেমনটি দেখতে স্বামী পছন্দ করেন। প্রতি সপ্তাহে নখ কাটুন। নিয়মিত দেহের অবাঞ্চিত পশম পরিস্কার করুন। কারণ এগুলো প্রতিটি রুচিশীল স্বামীর জন্যই বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে।
নিয়মিত সাবান মেখে গোসল করুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন । বিশেষ করে প্রতি মাসের বিশেষ অবস্থা থেকে উত্তরণের পর উত্তমরূপে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করুন। আর সেই বিশেষ অবস্থায়ও সাধ্যমত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে সচেষ্ট থাকুন। চুলে তৈল দিন। সম্ভব হলে শ্যাম্পু ব্যবহার করে মাথার চুলগুলোকে রেশমী চুলে পরিণত করুন। অলংকার থাকলে সেগুলো বাক্সে আবদ্ধ না রেখে মাঝে মধ্যে স্বামীর বলা কওয়া ছাড়াই নববধূ হয়ে সেজে থাকুন। এতে তিনি সীমাহীন খুশী হবেন। এসব করতে গিয়ে ‘অন্যেরা দেখলে কি বলবে’ এমন হীনমন্যতা অবশ্যই পরিহার করুন। সাথে সাথে এজন্য আপনি গর্ববোধ করুন যে, আপনি এমন এক ব্যক্তির জন্য এসব করতে পেরেছেন যার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির উপরই আপনার জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা নির্ভর করছে। সুতরাং এগুলো মোটেও কোন মামুলী বিষয় নয়।
ইসলামে বৈধ সাজসজ্জা ও রূপ-চর্চা করতে কোন নিষেধ নেই । উপরন্ত সাজ-সজ্জা না করে স্বামীর অন্তরে ঘৃণার বীজ বপন করা চরম বোকামী বৈ কিছুই নয়। স্বামীর মন জয় করতে পারাই আপনার জীবনের পরম সফলতা। মনে রাখবেন, আপনার সামান্য সচেতনতা, সামান্য সাজ-সজ্জা ও রূপচর্চা স্বামীকে বড় বড় গোনাহ থেকে বাঁচাতে পারে। নিমেষের মধ্যে দূর করে দিতে পারে হৃদয়ে পুঞ্জিভূত সকল দুঃখ-বেদনা ও অস্থিরতার কাল মেঘ।
আবুল ফারজ ইস্পাহানী আপন এক গ্রন্থে লিখেছেন, সুন্দরী রুপসী নারীদেরকেও স্বামীর নৈকট্য ও অপরিসীম ভালবাসা অর্জনের জন্য সাজ-সজ্জা করা প্রয়োজন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রূপচর্চা ব্যতিত স্বামীর হৃদয়ে আসন পেতে বসা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শুধু রূপ দিয়ে স্বামীর মন জয় করা যায় না। রূপের সাথে সাথে প্রয়োজন পরিমিত রূপচর্চা। ধৈর্য, সহ্য ও মহৎ গুণের। তাই খোদা প্রদত্ত সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষনীয়, চিত্তাকর্ষক ও লাবন্যময়ী করে স্বামীর সন্মুখে উপস্থিত করার জন্য সামর্থ অনুযায়ী বৈধ পন্থায়, সাজ-গোজ, বিভিন্ন ডিজাইনের পোষাক পরিচ্ছেদ, অলংকার ও সুগন্ধী ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়, যেমনটি স্বামী পছন্দ করেন ।
মুহতারাম বোনেরা! মনে রাখবেন, আপনি যখন উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রিয়তমা রূপে, প্রাণসজনী হিসেবে স্বামীর হৃদয় রাজ্যে আসন গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন, তখন দেখবেন, আপনার সমস্ত অভিযোগ, সমস্ত দুশ্চিন্তা আপনা আপনিই দূর হয়ে গেছে। তখন স্বামী আপনার আবেদন-নিবেদন মানার জন্য আন্তরিকভাবেই তৈরী থাকবে । শুধু তাই নয়, আপনার অভাব অভিযোগ ও মনের আশা পূর্ণ করতে পেরে তখন তিনি এক স্বর্গীয় তৃপ্তি অনুভব করবেন। সমস্ত হৃদয় জুড়ে বইতে থাকবে আনন্দের বন্যা। এছাড়া বড় বড় দোষ-ত্রুটি গুলোকেও তিনি ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনার বিরুদ্ধে কারও কথায় কান দিবেন না। কারণ আপনি এখন তার প্রিয়তমা, হৃদয় রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। পৃথিবীর আনত নয়না সুন্দরী ললনারাও আপনার স্বামীর দৃষ্টি ও মনকে তখন প্রতারণার ধুম্রজালে ফাঁসাতে পারবে না ।
আমি দৃঢ়তার সাথে ও সহস্র পুরুষের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, স্ত্রীর নিজ স্বামীর গৃহে পরিচ্ছন্ন না থাকা, নিজ অবয়বকে স্বামীর জন্য সজ্জিত না করা, স্বামীর দৃষ্টিতে নিজেকে অপরূপ সুন্দরীরূপে উপস্থাপন না করা, মিষ্টি-মধুর স্বামী-স্ত্রী সুলভ আচরণ থেকে বিরত থাকা, স্বামী-স্ত্রী উভয়কে অসংখ্য দুঃচিন্তার মধ্যে পতিত হতে বাধ্য করে। বৈবাহিক জীবনকে পরিণত করে জাহান্নামের অতল গহবরে।
সুতরাং আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করুন, আপনার স্বামী যখনই আপনার মুখপানে দৃষ্টিপাত করে তখনই যেন আপনার সাজ-সজ্জায় বিমোহিত হয়ে তার দৃষ্টি থেকে মহব্বতের বারিধারা বর্ষিত হয়। বিশেষ করে প্রতিবারই যেন আপনি নববধু অনুমিত হন, সেরূপ রূপচর্চা করে গৃহিনীর দায়িত্ব পালন করুন। তাহলে দেখবেন, আল্লাহ চাহেত আপনার অসংখ্য অগণিত পেরেশানী ও অভিযোগ দূর হয়ে যাবে । আর আপনার স্বামী হয়ে যাবে আপনার একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু ৷
এবার উপরোক্ত বক্তব্যের দলীল স্বরূপ হাদীস শরীফের কয়েকখানা উদ্ধৃতি পেশ করছি।
১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন নেক বিবির নিদর্শন হচ্ছে যখন স্বামী তার দিকে তাকায়, তখন সে (আন্তরিক ভালবাসা ও মুচকি হাসি দ্বারা) স্বামীকে সন্তুষ্ট করে দেয়। (তিরমিযি)
২। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে মেয়ে আপন স্বামীকে সন্তুষ্ট করার জন্য সাজ-গোজ করে সে দশ বৎসরের ইবাদতের ছাওয়াব প্রাপ্ত হবে। (বায়হাকী )
৩। একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, উত্তম নারী কে? জবাবে তিনি কয়েকটি গুণের কথা উল্লেখ করলেন । তন্মধ্যে প্রথম গুণটি হল, যে নারীর দিকে তাকালে তার মন খুশিতে ভরে যায়। (মিশকাত, নাসাঈ)
৪ । আবু সাইদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন কোন স্বামী বাহির থেকে ঘরে প্রবেশ করে মহব্বতের দৃষ্টিতে স্ত্রীর প্রতি তাকায় আর অনুরূপ ভালবাসার দৃষ্টিতে স্ত্রীও স্বামীর দিকে তাকায় তখন আল্লাহ তাআলাও উভয়ের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। (কানযুল উম্মাল, খন্ড ১৬ পৃঃ ২৭৬)
দুই. শ্রদ্ধাশীল হোন, অনুগত থাকুন : শ্রদ্ধা ও আনুগত্য শব্দ দুটো একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে শ্রদ্ধা আছে সেখানে আনুগত্য আছে। যেখানে শ্রদ্ধা নেই সেখানে আনুগত্যও নেই। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বন্ধু । কিন্তু পাশাপাশি স্বামী শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার পাত্রও বটে। সুতরাং স্ত্রী যদি বিবাহের পূর্বেই মনের ভিতর একথা গেঁথে নেয় যে, স্বামী আমার শিরোমনী, মাথার তাজ, সৰ্বাধিক শ্রদ্ধা পাওয়ার উপযুক্ত, তবে তার পক্ষে স্বামীর আনুগত্য করা, স্বামীর প্রতিটি আদেশ-নিষেধ মেনে চলা খুবই সহজ হবে। কেননা সাধারণ নিয়ম এই যে, যে যাকে শ্রদ্ধা করে সে তাকে মেনে চলে। মেনে চলার জন্য আন্তরিকভাবে তৈয়ারও থাকে।
যে সকল স্ত্রী নিজেকে স্বামীর সমকক্ষ মনে করে, তাদের পক্ষে স্বামীর প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন কখনোই সম্ভব হয় না। স্বামীর আদেশ-নিষেধ পালন করাকে নিজের জন্য হেয় বলে মনে করে। কারণ দুনিয়ার সাধারণ নিয়মও এই যে, মর্যাদায় পরস্পর সমান, এরূপ ব্যক্তিরা একে অপরকে নির্দেশ দিলে তা অন্যের জন্য বোঝা বলেই প্রতীয়মান হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মোট কথা, দাম্পত্য জীবনের মূল কথা হল, স্বামীর মহত্ব, বড়ত্ব ও শ্রদ্ধাকে আপন হৃদয়ে স্থান দেয়া। আর একথাও ভাল করে স্মরণ রাখা যে, ‘তিনি আমার স্বামী’ শুধু এতটুকুর জন্যই তিনি শ্রদ্ধার উপযুক্ত। অন্য কোন গুণের কারণে নয় । কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু স্বামীর সেবা ও তার আনুগত্য করার কথা বলেছেন। তিনি একথা বলেননি যে, স্বামী যদি এমন এমন গুণের অধিকারী হয় তাহলে তোমরা তাদের সেবা ও আনুগত্য করিও। অন্যথায় নয় । এক কথায়, স্বামী কেবলই স্বামী হওয়ার কারণে শ্রদ্ধা ও ভক্তি পাওয়ার উপযুক্ত ।
সুতরাং কোন স্ত্রী যদি মনে করে যে, আমার স্বামী দ্বীনদার নয়, কিংবা তার কোন ডিগ্রি নেই, অথবা তিনি দেখতে শুনতে ভাল নন, তাই তিনি শ্রদ্ধা পাওয়ারও উপযুক্ত নন। সম্মানিত পাঠক-পাঠিকা! আপনারাই বলুন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস মোতাবেক উক্ত স্ত্রীর ধারণাটা কি মারাত্মক ভুল নয়? এরুপ ধারণা পোষণ করা কি চরম নির্বুদ্ধিতা নয়? অবশ্যই ।
তাই মা-বোনদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, স্বামী সর্বাধিক শ্রদ্ধার পাত্র- এ ছোট্ট বাক্যটি হৃদয়ে বসানোর চেষ্টা করুন । তাকে কষ্ট দিবেন না । কষ্ট দেয়ার চেষ্টাও করবেন না । স্বামীর হক সম্পর্কিত বিভিন্ন ধৰ্মীয় বই পুস্তক পড়ুন। তাহলে দেখবেন, স্বামীর মন কিভাবে জয় করতে হবে তা আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না । তখন আপনি নিজেই আপন বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্বামীর মেযাজ, স্বভাব, মনের গতি, মনের কামনা- বাসনার প্রতি সম্যক অবগতি লাভ করে সে অনুপাতে চলতে চেষ্টা করবেন। এমতাবস্থায় স্বামীর অধিকার সম্পর্কিত কোন কথা শুনলে কিংবা এ জাতীয় কোন গ্রন্থ হাতে পড়লে আপনি কেবল খুশিই হবেন না, মন থেকে লেখককে ধন্যবাদও দিবেন ।
পক্ষান্তরে আপনার হৃদয়ে যদি স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত না হয়, তাহলে এধরণের কোন বই-পুস্তক হাতে পেলে মনে মনে আপনি ক্ষুদ্ধ হবেন। বলবেন, হুজুর-মাওলানারা শুধু পুরুষদের কথাই লিখে, তাদের হক সম্পর্কেই সবিস্তার আলোচনা করে, আমাদের হক নিয়ে একটি কথাও লিখে না, একটি কথাও বলে না। অবশ্য একথাটি একদিক দিয়ে সত্যও বটে । কেননা স্বয়ং আমিই এ পর্যন্ত আমার কোন বইয়ে স্ত্রীদের হক সম্পর্কে আলোচনা কিংবা কোন ঘটনা উল্লেখ করিনি । অথচ চলমান বইয়ের আগে যে গল্পে হৃদয় গলে নামে তিনটি খন্ড ও যে গল্পে অশ্রু ঝরে নামে একটি বই আত্মপ্রকাশ করেছে।
তবে মেয়েদের জন্য সুসংবাদ এই যে, হৃদয় গলে সিরিজের ৬নং অংশের শুরুতেই (যার নাম-“যদি এমন হতাম”) স্ত্রীদের হক ও অধিকার সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনা স্থান পেয়েছে। আশা করি আপনারা তা পাঠ করে তৃপ্তি বোধ করবেন । খুশি হবেন । দেখুন: প্রেমময় জীবনের মধুর অভিমান!
এবার আলোচ্য বিষয়টুকু সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের একখানা আয়াত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’খানা হাদীছ পেশ করছি। (১) আল্লাহপাক বলেন, সতী নারীরা স্বামীদের অনুগত হয় এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে আল্লাহ যা হিফাজত করার নির্দেশ দিয়েছেন তা হিফাযত করে।(সুরা নিসা : ৩৪) (২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে মহিলা নিজ স্বামীর উপর অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং অকারণে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে তার উপর আল্লাহর লানত পতিত হয়। (ইরশাদে নববী : ৮০) (৩) হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কোন মহিলা তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখন আল্লাহর তাআলার পক্ষ থেকে স্বামীদের স্ত্রীরূপে নির্ধারিত বেহেশতের ডাগর চোখ বিশিষ্ট হুরগণ দুনিয়ার স্ত্রীদেরকে লক্ষ্য করে বলতে থাকে- তুমি তাকে কষ্ট দিও না। কারণ, সে তো তোমার কাছে কয়েকদিনের মেহমান মাত্র। শীঘ্রই সে তোমাদের ছেড়ে আমাদের নিকট চলে আসবে । (তিরমিযি)
তিন. ক্ষমা চাইতে অভ্যস্থ হোন : স্ত্রী সর্বদাই স্বামীকে খুশি রাখতে চাইবে । অত্যন্ত হুশিয়ার থাকবে যেন তার কোন কথা বা কাজ দ্বারা স্বামী মনে কষ্ট না পান। নাখোশ না হন। কিন্তু এরপরেও যদি স্বামী কোন কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। প্রয়োজনে পা ধরে মাফ চাইবেন। যখন দেখবেন, তিনি অন্তর থেকে মাফ করে দিয়েছেন, তখনই কেবল স্বস্তিবোধ করবেন। খুশি হবেন। এর আগে নয়। কেননা স্বামীকে নারাজ রেখে কোন দ্বীনদার ও বুদ্ধিমতি স্ত্রী খুশি থাকতে পারে না। বরং সে তো তখন এ কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়বে যে, খোদা না করুন, যদি এ অবস্থায় আমার মৃত্যু এসে যায় তাহলে তো আমার জন্য জাহান্নাম অবধারিত। সুতরাং যে কোন উপায়ে তাকে খুশি করতেই হবে। যা বললে, যা করলে, যা দিলে তিনি খুশি হবেন তাই বলবেন, তাই করবেন, তাই দিবেন। মনে চাইলেও দিবেন। না চাইলেও দিবেন। কেননা এতে স্বামী যেমন খুশি হবেন, আল্লাহ তায়ালাও খুশি হবেন। মোট কথা, স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে মুখ ভার করে রাখলে আপনিও তখন গাল ফুলিয়ে বসে থাকবেন না। বরং তাকে খোশামোদ-তোষামোদ করে অনুনয়-বিনয় করে রাযী খুশি করে নিবেন। এক্ষেত্রে আপনার যদি কোন অপরাধ নাও থাকে তবুও আপনি রাগ করবেন না। বরং নিজকে অপরাধী সাজিয়ে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং একে গর্বের বিষয় মনে করবেন।
হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেহেশতী লোকদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ঐ মহিলাও বেহেশতী, যে গোস্বা অবস্থায় স্বামীর হাত ধরে বলে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি রাযী না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ক্ষণিকের জন্যও কিছু খাবো না এবং অবশেষে তাকে রাযীও করে ফেলে । (হাবিউল আরওয়াহ : ১১৪)
চার. বিরোধিতার পথ পরিহার করুন : পুরুষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল, সে নিজের বিষয়ে কারও বিরোধিতা বরদাশত করতে পারে না। বিশেষ করে স্ত্রী বিরোধিতা করলে তার মেযাজ অগ্নিতুল্য হয়ে যায়। তাই আপনি যদি দাম্পত্য জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে আন্তরিকভাবেই প্রয়াসী হয়ে থাকেন, তবে অনুগ্রহ করে স্বামীর বিরোধীতা করবেন না। কোন দাবী বা বক্তব্য থাকলে তা অন্য সময় অন্য কোন পন্থায় উপস্থাপন করুন। মনে রাখবেন, বুদ্ধিমতী স্ত্রী কখনও প্রকাশ্যে স্বামীর বিরোধীতা করে না। কোন বিষয় মতের খেলাফ হলেও তৎক্ষনাৎ তা প্রকাশ করে না। বরং এমন সময় খোঁজতে থাকে যখন বললে স্বামী অসন্তুষ্ট হবে না। আবার কথাও কার্যকর হবে। স্বামী যদি রাগান্বিত হয়ে গালমন্দ করেন, তাহলে নীরবে ধৈর্যধারণ করবেন। কখনই স্বামীর মুখের উপর প্রতিউত্তর করবেন না। তর্কে লিপ্ত হবেন না। রাগ থেমে গেলে দেখবেন স্বামী নিজেই লজ্জিত হবে এবং আপনার প্রতি আরও খুশি হবে। আর ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ আপনার প্রতি কখনো রাগান্বিত হবেন না। পক্ষান্তরে যদি উত্তর দিতে যান তাহলে কথা কাটাকাটি হতে হতে তা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে তা আল্লাহই ভাল জানেন ।
পাঁচ. স্বামীর উপহার আনন্দচিত্তে গ্রহণ করুন : স্বামী যদি আপনার জন্য কোন জিনিষ সখ করে কিনে আনেন, তবে তা অত্যন্ত খুশী মনে গ্রহণ করুন। চাই উহা আপনার পছন্দ হোক বা না হোক । কখনও এরূপ বলবেন না যে, এটা আমার পছন্দ হয়নি, এত দাম দিয়ে মানুষ এগুলো কিনে নাকি? ইত্যাদি । কারণ এতে স্বামী মনক্ষুন্ন হবেন। এরপর আর কোন জিনিষ আনতে মন চাইবে না। আর যদি আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করেন তাহলে স্বামীর হিম্মত বাড়বে এবং ভবিষ্যতে আরও ভাল জিনিষ আনার চেষ্টা করবেন।
ছয়. সন্দেহ প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকুন : স্বামীকে ভাল করে না বুঝে অহেতুক সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকুন। এতে স্বামীর উপর থেকে আপনার বিশ্বাস হারিয়ে যেতে পারে। আর বিশ্বাস হল ভালবাসার মূলমন্ত্র বা ভিত্তি। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালবাসাও নেই । তাই ছোটখাট কোন বিষয় দেখেই স্বামীকে দোষারোপ করবেন না। তার উপর অপবাদ উঠাবেন না। যেমন বললেন, আপনাকে অমুক মহিলার সাথে হাসতে দেখেছি। তার কাছে এত আসা যাওয়া কেন? মনে হয় তার প্রেমে পড়েছেন, তার সাথে বসে কি করেন?
কারণ স্বামী যদি প্রকৃতপক্ষে নিরপরাধী থাকে এবং বিশেষ কোন কারণ বা অবস্থার পরিপেক্ষিতেই এরূপ হয়ে থাকে তাহলে তো এটা আপনার অন্যায় হবে এবং অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। আর যদি বাস্তবেই অপরাধী হয়ে থাকে তবুও আপনার চাপ প্রয়োগে তার জিদ আরও বেড়ে যাবে। স্মরণ রাখবেন, এভাবে চাপ দিয়ে কিংবা কটু কথা বলে কখনোই তাকে এসব কর্মকান্ড থেকে ফিরাতে পারবেন না। আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই নিজের এবং স্বামীর কল্যাণ কামনা করেন তাহলে তাকে নীরবে বুঝান। আন্তরিক ভালবাসা ও সেবা দিয়ে আরও বেশী পরিমাণে তার প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করুন। এতেও যদি তিনি না ফিরেন, তাহলে ধৈর্যধারণ করুন। পুরুষের মেযাজে যেহেতু কঠোরতা রয়েছে, তাই বাড়াবাড়ি করতে গেলে আপনারই ক্ষতি হবে ।
সাত. স্বামীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন : স্বামীগণ নিজ নিজ স্ত্রীকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসবে, হাস্য-রসিকতা করবে, আদরে সোহাগে মাতিয়ে রাখবে। অনুরূপভাবে স্ত্রীরাও প্রতিউত্তরে হাসির ফোয়ারায় হৃদয় সিক্ত করে স্বামীর ভালবাসা জয় করবে- এটাইতো দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক চিত্র। তবে সাথে সাথে স্বামীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করা যা মহব্বত ও ভালবাসার চূড়ান্ত রূপ, সেদিকেও যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে । এক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই বিনা কারণে বিলম্ব কিংবা অনীহা ভাব প্রকাশ করা যাবে না। কেননা এমতাবস্থায় অনীহা প্রদর্শন করলে বিবাহ করার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে পারে। শুধু তাই নয়, খোদা না করুন, এরূপ ক্ষেত্রে বারবার বিলম্ব বা অধিকাংশ সময় গুরুত্ব না দিলে কারও কারও বেলায় বিপদগামী হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর এ বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েদেরকে এ ব্যাপারে সাবধান ও সচেতন করতে যেয়ে বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে আপন মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য আহ্বান করে আর সে কোন শরয়ী ওজর বা অপারগতা ছাড়া স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয় তবে ভোর পর্যন্ত ফেরেশতারা তার উপর লা’নত করতে থাকে। (বুখারী)
অপর এক হাদীসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন স্বামী তার স্ত্রীকে নিজের হাজত পূর্ণ করার জন্য ডাকে, তখন স্ত্রীর উপর ওয়াজিব সঙ্গে সঙ্গে ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেকে স্বামীর সামনে পেশ করা; যদিও সে রন্ধনরত অবস্থায় থাকুক না কেন । (তিরমিযি)
এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল, স্ত্রী যে কোন কাজেই ব্যস্ত থাকুক না কেন, স্বামী তার আপন চাহিদা পূর্ণ করতে চাইলে স্ত্রীকে তখন অবশ্যই স্বামীর মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অবশ্য শরয়ী কোন ওজর বা গ্রহণযোগ্য অপারগতা থাকলে সেটা স্বামীকে খুলে বলে বিনয়ের সাথে সাময়িকভাবে এ থেকে অব্যাহতি নিতে হবে। যাতে স্বামী বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং মনে ব্যথা না পান ।
ফতোয়ায়ে কাযীখান নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, স্বামী তার স্ত্রীকে চার কারণে প্রহার করতে পারেন । তন্মধ্যে একটি হল, স্বামী যদি আপন জৈবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য স্ত্রীকে আহবান করে, আর স্ত্রী বিনা কারণেই তা প্রত্যাখ্যান করে।
আট. সাধ্যাতীত খরচ-পাতি চাওয়া থেকে বিরত থাকুন : স্বামীর সামর্থের ঊর্ধ্বে ভরণ-পোষণ দাবী করা কখনও উচিত নয়। কারণ এতে স্বামী মনে মনে ভীষণ কষ্ট পান। তাই অনায়েসে যা কিছু মিলে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন। এতে আল্লাহ পাক আপনার উপর সীমাহীন খুশি হবেন । স্বামীর সঙ্গতি না থাকলে কাজের বুয়া রাখার জন্যও চাপ প্রয়োগ করবেন না । একটু কষ্ট করে নিজের কাজ নিজেই করে নিন। হ্যাঁ, যদি একেবারে অপারগ হয়ে যান তাহলে বিনয়ের সাথে স্বামীকে এ ব্যাপারে অবহিত করলে তিনি অবশ্যই বুঝবেন এবং উক্ত সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিবেন। আর্থিক অবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে আপনার চাহিদা মত ভরণ- পোষণ দিতে স্বামী অক্ষম হলে এজন্য কখনই তাকে তিরস্কার করবেন না। তাচ্ছিল্যের চোখে দেখবেন না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে নারী গরীব স্বামীকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে এবং তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, বেহেশত তো দূরের কথা, বেহেশতের সুগন্ধও তার কপালে জুটবে না। (তিরমিযি)
নয়. সর্বদা স্বামীর প্রতি খেয়াল রাখুন : স্বামীর ভাল লাগা মন্দ লাগা বিষয়গুলো কৌশলে প্রথমেই জেনে নিন। তার কখন কি প্রয়োজন এর প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখুন। তার ব্যবহার্য জিনিষগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে রাখুন । যখন যা প্রয়োজন এগিয়ে দিন । ওজুর প্রয়োজন, তো বদনা ভরে পানি দিন। গোছলের প্রয়োজন হলে টিউবওয়েল চেপে বা টেপ ছেড়ে পানির ব্যবস্থা করুন। শীতকাল হলে পানি গরম করে দিন। ওজু-গোছল শেষ হলে গামছা বা তোয়ালে হাতে তুলে দিন। আরও বেশী পূণ্য লাভ করতে চাইলে স্বহস্তে শরীর মুছে দিন। বের হওয়ার সময় জুতোগুলো পরিস্কার করে দরজার সামনে রেখে দিন। সম্ভব হলে নিজের হাতে জুতা-মোজা পরিয়ে দিন। সফর থেকে এলে সর্বপ্রথম তার হাল-অবস্থা জিজ্ঞাসা করুন। আপনি সেখানে কিভাবে ছিলেন? কোন কষ্ট হয়নি তো? অতঃপর খানাপিনার প্রয়োজন আছে কিনা জিজ্ঞাসা করুন। প্রয়োজন থাকলে যা তৈরী থাকে তাৎক্ষণিকভাবে তার সামনে উপস্থিত করুন । খানাপিনা থেকে অবসর হয়ে শুইতে গেলে তার হাত পা ও শরীর দাবিয়ে দিন। গরমের মওসুম হলে পাখা করুন। প্রথমেই নিজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন কথা মুখ দিয়ে ঘুর্ণাক্ষরেও উচ্চারণ করবেন না। হ্যাঁ, যদি হাসি-খুশীর অবস্থায় কথা প্রসঙ্গে মওকা পেয়ে জিজ্ঞাসা করে নিন তাহলে কোন অসুবিধা নেই। মোট কথা, স্বামী যেন আপনাকে স্বার্থপর ভাবার সুযোগ না পান, কিংবা আপনার আচার- আচরণে মনে কষ্ট অনুভব না করেন, সেদিকে খেয়াল রাখা আপনার নৈতিক দায়িত্ব ।
দশ. স্বামীর স্বজনদের সাথেও ভাল ব্যবহার করুন : স্বামীর আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সকলের সাথে ভাল ব্যবহার করুন । পর্যায়েক্রমে প্রত্যেকের হক ঠিকঠাক মত আদায়ের জন্য সচেষ্ট হোন। কখনও তাদের সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হবেন না। এমন কোন কথা মুখে উচ্চারণ করবেন না, যদ্বারা তারা মনে মনে কষ্ট পায় । কেননা স্বামীর স্বজনদের মনে কষ্ট দেয়া মানে প্রকারান্তরে স্বামীকেই কষ্ট দেয়া। সুতরাং এ বিষয়টির প্রতি খুব খেয়াল রাখুন।
এগার. দ্বীনদারীর পরিমান বাড়াতে থাকুন : শান্তির সম্পর্ক দ্বীনদারীর সাথে। যে যত বড় দ্বীনদার, পরহেযগার ও আল্লাহওয়ালা তার অন্তর ততটা প্রশান্তিময়। সুতরাং স্বামীর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও খেদমতের পরিমান বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্বীনদারী বাড়াতে সচেষ্ট হোন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রথম ওয়াক্তে আদায় করুন। রমজান মাসে রোজা রাখুন। আপন সতীত্বের হেফাযত করুন। নিয়মিত কোরআনে পাক তিলাওয়াত করুন। শরয়ী পর্দায় অভ্যস্থ হোন। বাসায় তালীমের পরিবেশ কায়েম করুন। ছেলে-মেয়েদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দিন। নেসাব পরিমাণ মাল থাকলে প্রতি বছর হিসাব করে যাকাত আদায় করুন। স্বামীকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাবলীগে পাঠান । সম্ভব হলে নিজেও মাহরাম পুরুষদের সাথে তাবলীগের জন্য বের হয়ে যান ।
বেশী বেশী করে মৃত্যুর কথা স্মরণ করুন। অবসর সময়ে ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়তে থাকুন। এতে একদিকে আপনার জ্ঞানের পরিধি বাড়বে আবার অপর দিকে ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেও পারবেন। সম্ভব হলে স্বামীর সাথে পরামর্শ করে একটি পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তুলুন। যা আপনাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য বিরাট এক সম্পদ বলে বিবেচিত হবে। ছোট বেলা থেকেই এরা ধর্মীয় মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে। তখন ধর্ম পালনের জন্য আপনাদের এত তাকীদ দিতে হবে না। নিজে নিজেই তারা ধর্মের বিভিন্ন বিধি- বিধান পালনের জন্য সচেষ্ট হবে। আমি আপনাদের সুবিধার জন্য কিছু ধর্মীয় বইয়ের নাম লিখে দিচ্ছি। আশা করি এ বইগুলো সংগ্রহ করে পড়তে পারলে অনেক উপকৃত হবেন । (উল্লেখ্য যে, এ বইগুলো আমি নিজেও পাঠ করেছি। আমার পাঠ করা অসংখ্য বইয়ের মধ্যে এ বইগুলো সর্বাধিক ভাল লেগেছে বিধায় এগুলো সংগ্রহ করতে আপনাদেরকে উৎসাহিত করলাম।)
(১) ইরান দুহিতা (উপন্যাস)। (২) আলোর পরশ (উপন্যাস) ইসলামিক ফাউন্ডেশন (৩) আনোয়ারা (উপন্যাস) (৪) মরণজয়ী (উপন্যাস) (৫) মুহাম্মদ বিন কাসিম (উপন্যাস) (৬) ধন্য আমি নারী (৭) সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর দুর্বার অভিযান -১,২ (৮) মরণজয়ী মুজাহিদ (উপন্যাস) (৯) জুলফিকার (উপন্যাস) (১০) ঈমান দীপ্ত দাস্তান (উপন্যাস) (১১) বেহেশতী জেওর (১২) যে পথে মুক্তি মিলে (১৩) যে গল্পে হৃদয় গলে-১ম, ২য় ও ৩য় খন্ড। (১৪) যে গল্পে অশ্রু ঝরে, (১৫) আগুনের কারাগার (১৬) জীবন্ত পাহাড়ের সন্তান (১৭) আধার রাতের বন্দিনী (১৮) সীমান্ত খুলে দাও (১৯) কাশ্মীরের কান্না (২০) ফাযায়েলে আমল (২১) হায়াতুস সাহাবা (২২) সত্যের বিজয় (উপন্যাস)। (২৩) মুমিনের রক্তে রঞ্জিত বিশ্ব। (২৪) তায়াল্লুক মাআল্লাহ (২৫) আত্মশুদ্ধি (২৬) নূরানী কাফেলা (২৭) ফাযায়েলে ছাদাকাত (২৮) খুন রাঙ্গা পথ (২৯) সীমান্ত ঈগল (৩০) ইউলিয়া কেরামের কান্না (৩১) উস্তাদ শাগরেদের হক (৩২) আমরা যাদের উত্তরসূরী (৩৩) জবানের হেফাজত (৩৪) জাযাউল আমল ।
বার. সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করুন : আপনি যত কিছুই করুন না কেন, তা যেন শুধু আল্লাহর জন্য হয়। মানুষকে দেখানোর জন্য, বড়ত্ব প্রকাশের জন্য কিংবা বাহবা কুড়ানোর জন্য ধর্মীয় কাজ করলে এর বিন্দুমাত্রও ছাওয়াব পাবেন না। তাই স্বামীর সেবাসহ যত কাজের কথা এখানে উল্লেখ করা হল, অনুগ্রহ করে এগুলো আল্লাহর রাযী-খুশীর জন্য করবেন। প্রত্যেকটি কাজের পূর্বে নিয়ত ঠিক আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিবেন। নিয়ত ঠিক না থাকলে এস্তেগফার পড়ে নিয়ত ঠিক করে নিবেন। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সমস্ত কাজের সাওয়াব নির্ভর করে নিয়তের উপর । (বুখারী)
অর্থাৎ নিয়ত ছহীহ হলে সাওয়াব পাবে। আর নিয়ত গলদ হলে ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। উপরন্ত এরূপ নিয়তের ফলে ঐ কাজে আল্লাহ পাকের রহমত, বরকত ও সাহায্য থাকে না। অতএব এ বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিবেন।
তের. আকর্ষনীয় ভঙ্গিমায় পত্র লিখুন: স্বামী যদি পেশাগত কিংবা অন্য কোন কারণে দূরে অবস্থান করেন, তাহলে মাঝে মধ্যে তার নিকট পত্র লিখুন। যত পারেন, পত্রের কলেবর বৃদ্ধি করুন। কারণ এক্ষেত্রে দীর্ঘ চিঠিই কাম্য। তবে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দুটি কথা খেয়াল রাখবেন। (১) পত্রের ভাষা যেন অবশ্যই আকর্ষনীয় ও প্রাণবন্ত হয়। সাহিত্যের রস যেন এতে থাকে। প্রয়োজন হলে এজন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করুন। হাতের লেখা সুন্দর করতে চেষ্টা করুন । লাইন সোজা রাখুন। পত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার করুন। আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে এমনভাবে প্রতিটি বাক্য উপস্থাপন করুন, যেন পত্র পাঠের সময় আপনার সুন্দর মুখটি স্বামীর চোখের সামনে ভেসে উঠে। হৃদয়ের গহীন কোন থেকে আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার মানসিকতা তৈরী হয় ।
কোন কোন স্ত্রী পত্রের শেষে একটু অভিনয় করতে গিয়ে লিখে, আপনার কালা বউ। আবার কেউ কেউ লিখে, আপনার হতভাগ্য স্ত্রী। মনে রাখবেন, এসব লেখার দ্বারা স্বামীরা মনে দুঃখই পায় ৷ আনন্দ অনুভব করেন না। খুশী হন না ।
যে স্ত্রী উপরে উল্লেখিত প্রথম বাক্যটি ব্যবহার করলেন, তিনি হয়ত মনে করছেন, এর দ্বারা আমি স্বামীর সামনে বিনয় প্রকাশ করে তার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে গেলাম। অথচ এ শ্রেণীর শব্দগুলো যে কত শ্রুতিকটু, তা প্রতিটি রুচিবান ব্যক্তি সহজেই বুঝে থাকেন। সুতরাং এসব আজে বাজে বাক্য বাদ দিয়ে লিখুন- ইতি, আপনার হৃদয়ের রাণী, আপনার প্রিয়তমা, আপনার অর্ধাঙ্গিনী, আপনার আদরিনী, আপনার সোহাগীনী, আপনার মানসী, আপনার চোখের জ্যোতি, আপনার স্বপ্নের রাণী ইত্যাদি। (২) পত্রের মধ্যে এমন কোন বাক্য লিখবেন না, যদ্বারা স্বামী মনে কষ্ট পাবেন কিংবা পেরেশানীতে ভুগবেন। তবে এমন কথা, যা না লিখলেই নয়, তা অবশ্য প্রয়োজনের খাতিরে অত্যন্ত সহজভাবে লিখতে পারেন। তবে সাথে সাথে শান্তনামূলক কথাও লিখে দিবেন। যাতে তার দুঃখের মাত্রাটা কমে যায়।
চৌদ্দ, স্বামীর নাম নিয়ে সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকুন : স্ত্রীর জন্য স্বামীর প্রতি অগাধ ভালবাসা, শ্রদ্ধা-ভক্তি অন্তরে পোষণ করা অপরিসীম কর্তব্য। চাল-চলন, কথা-বার্তা কিছুতেই যেন স্বামীর সম্মানে নূন্যতম আঘাত না আসে সে দিকে স্ত্রীকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে ।
স্বামীকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রেও উক্ত বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। বেয়াদবী হতে পারে এধরণের কোন শব্দ দ্বারা স্বামীকে সম্বোধন করা যাবে না। স্ত্রীর জন্য স্বামীর নাম নিয়ে ডাকা বেয়াদবীর শামিল এবং এটা মাকরুহও বটে। তাই এ ব্যাপারে স্ত্রীকে সতর্ক থাকা উচিত। (ফাতওয়া রহীমিয়া ২ঃ৪১৩)
আরও পড়তে পারেন: স্বামীকে ডাকার জন্য রোমান্টিক নাম
পরিশেষে আমার প্রিয় মা-বোনদের বলছি, সুখ কখনো ইচ্ছে করে ধরা দেয় না, তা অর্জন করতে হয় । আর কিভাবে তা অর্জন করা যাবে তা নিজেই বুদ্ধিমত্তা দিয়ে চিন্তা ফিকির করে বের করে নিতে হবে । আমি কেবল আপনাদের একটি রাস্তা দেখিয়ে দিলাম। তবে মনে রাখবেন, এ পথে চলতে প্রয়োজন হবে আপনার ঈমানদীপ্ত আন্তরিকতা ও কঠোর শ্রম-সাধনা। তবেই হাতে পাবেন সুখ নামক সোনার হরিণটি । আল্লাহপাক আমাদের তাওফীক দিন। আমীন। (সূত্রঃ হেকায়েতে সাহাবা)
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম। লেখকের যে গল্পে হৃদয় কাড়ে – হৃদয় গলে সিরিজ ৫ থেকে সংগ্রহিত।
নোট: লেখকের অনেক কথায় আমার মনোপুঃত হয়নি। তবে আপনার স্ব-চেতনা থেকে লেখকের পুরো কথাগুলো অনুসরণ করতে পারেন অথবা আপনার যতটুকু মনে ধরেছে ততটুকুই মানতে পারেন। মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক।
আপনি আরও পড়তে পারেন..
০১. আদর্শ স্বামী স্ত্রী ১ : দাম্পত্য জীবনের গল্প
০২. আদর্শ স্বামী স্ত্রী ২ (শিক্ষণীয় গল্পের বই)
০৩. ব্যথিত হৃদয় (ইসলামিক উপন্যাস ১)