মানব প্রকৃতি মাটির প্রকৃতির ন্যায়

মানব প্রকৃতি মাটির প্রকৃতির ন্যায়। তাই আপনারগত কৌশল হওয়া উচিৎ মাটির প্রকৃতির ন্যায়। আপনি যদি মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি বুঝতে পারেন তাহলে সহজেই ভালোবাসা অর্জন করতে পারবেন। কিভাবে আপনি মানব প্রকৃতির আচরণগত কৌশলটি আয়ত্ত্ব করবেন তা শিখতে সম্মানিত লেখকের এই আর্টিকেলটি অধ্যায় করুন। সম্মানিত লেখক মানব প্রকৃতি আচরণগত কৌশলের ভিন্নতা গুলো বর্ণনা করেছেন। 

মানব প্রকৃতি মাটির প্রকৃতির ন্যায় (লাইফস্টাইল টিপস ২০)

আপনি যদি মানুষের প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে দেখবেন। মাটি যেমন বিভিন্ন স্বভাবের, মানব প্রকৃতিও তেমনই বিভিন্ন রকমের। কোনো কোনো মানুষের স্বভাব অনেক নরম ও কোমল আবার কিছু মানুষের স্বভাব শক্ত ও কঠিন। অনেকের মন উদার যেন শষ্য-শ্যামল উর্বর ফসলী জমি। আবার অনেকের মন সংকীর্ণ, অনাবাদী অনুর্বর ভূমির মতো, যাতে না পানি জমে, না ফল ও ফসল ফলে। সারকথা হলো, মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি এক রকম নয়। মাটির তৈরি মানুষ, মাটির ভিন্নতার ন্যায় বিভিন্ন প্রকৃতির অধিকারী।

আপনি খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, আমরা মাটির ধরণ অনুযায়ী মাটির সাথে আচরণ করি। শক্ত মাটির সাথে আচরণ আর নরম মাটির সাথে আচরণ কখনো এক রকম হয় না। নরম, কাদাময় ও পিচ্ছিল মাটিতে আমরা যেভাবে পা টিপটিপ করে হাটি শক্ত মাটিতে সেভাবে হাটি না। কাঁদা মাটিতে হাটতে গেলে আমরা খুব সাবধানে পা ফেলি অথচ শক্ত মাটিতে আমরা নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করেও চলতে পারি। মানুষের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও অনুরূপ খেয়াল রাখতে হবে।

রাসূল (সাঃ) বলেন—

অর্থ : আল্লাহ তাআলা সারা পৃথিবী থেকে একত্রিত করা একমুষ্টি মাটি থেকে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন। মাটির ভিন্নতার কারণে আদম সন্তানের আকার ও প্রকৃতিতে ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। তাই আকার আকৃতিতে কেউ লাল, কেউ সাদা, কেউ কালো আবার কেউ মাঝামাঝি বর্ণের। আর স্বভাবের দিক দিয়ে মানুষ কেউ উদার স্বভাবের, কেউ বা সংকীর্ণ, আবার কেউ মন্দ, কেউ ভাল। (সুনানে তিরযিমী: ২৮৭৯, সহীহ ইবনে হিব্বান : ৬২৬৬)

এজন্য মানুষের সঙ্গে আচরণ করার সময় এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখা উচিৎ। সে আত্মীয় হোক কিংবা অনাত্মীয়। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান প্রতিবেশী, সহপাঠী, ক্রেতা-বিক্রেতা সহযাত্রী তথা যে কারো সাথে আচরণের সময় উপর্যুক্ত বিষয়টি মাথায়  রাখতে হবে।

আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও মানুষের এ স্বভাবের ভিন্নতা প্রভাব ফেলে থাকে। আপনি নিজে এটা যাচাই করে দেখতে পারেন। মনে করুন, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার কোনো সমস্যা হলো। এখন আপনার যে বন্ধুটি সবচেয়ে কঠিন প্রকৃতির বলে মনে করেন, তাঁর কাছে আপনি পরামর্শ চান। তাকে বলুন, ‘ভাই! আমার স্ত্রী তো আমার জন্য কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার কথা মানে না, আমার সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে, এখন আমি কী করব?’

আমার মনে হয় সে বলবে, ‘মহিলাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে তাদের সাথে সব সময় গরম মেজাজে ও চোখ লাল করে কথা বলতে হবে। তাঁর মান অভিমান শেষ করে দেবে। আর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও শক্তিমত্তার পুরোপুরি প্রদর্শন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো নারীর সামনে তোমার পুরুষত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে।’

আপনি যদি তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করে বাড়িতে গিয়ে তা প্রয়োগ করেন তাহলে আপনার সংসার ভেঙ্গে যেতে পারে।

আপনি যদি পরীক্ষাটা পূর্ণ করতে চান তাহলে এবার আপনার সবচেয়ে কোমল স্বভাবের একজন বন্ধুর শরণাপন্ন হয়ে আগের বন্ধুকে যা বলেছিলেন তাকেও তা বলুন। দেখবেন, সে অবশ্যই বলবে ‘ভাইজান, সে শুধু তোমার স্ত্রী নয়। সে তোমার সন্তানদেরও মা। আর দাম্পত্য জীবনে কেউ সমস্যামুক্ত নয়। তুমি সবর কর। তাঁর ক্রটিগুলো সহজভাবে নিতে চেষ্টা কর। আর যাই হোক সে তো তোমার অর্ধাঙ্গিনী, জীবন পথের সহযাত্রী।’

মানুষের স্বভাব তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে তা খেয়াল করে দেখুন এ কারণেই রাসূল (সাঃ) পিপাসায় কাতর, ক্ষুধার্ত বা প্রাকৃতিক প্রয়োজনের প্রবল চাপ অবস্থায় বিচারককে কোনো রায় প্রদান করতে নিষেধ করেছেন। কেননা, এগুলো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রাচীনকালে বনি ইসরাঈলের কোনো এক এলাকায় দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির এক রক্তপিপাসু খুনী বাস করত। হ্যাঁ, তাকে রক্তপিপাসুই বলতে হবে। কারণ সে এক দু’জন বা দশ বিশ জনকে নয়, নিরানব্বই জন ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। জানি না এতো লোক হত্যা করে কীভাবে সে বেঁচে থাকল। হয়তো সে এতো ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ছিল যে কেউ তাঁর কাছে যেতেই সাহস করত না, নয়তো সে দুর্গম কোনো পাহাড়ে বা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো। যা-ই হোক, সে নিরানব্বই জন লোককে হত্যা করেছিল।

কিন্তু হঠাৎ একদিন তাঁর হৃদয়রাজ্যে বিশাল এক পরিবর্তন এলো। অন্যায়ের প্রতি তাঁর মনে ঘৃণা সৃষ্টি হল। অনুশোচনা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরল। তওবার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে তখন সে যুগের সবচেয়ে বড় আলেমের সন্ধান জানতে চাইল। লোকেরা তাকে এক আবেদের সন্ধান দিল। সে এক উপাসানালয়ে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করে। এক মুহুর্তের জন্যও নামাযের জায়গা ছেড়ে কোথাও যায় না। তাঁর দিন-রাত কাটে ক্রন্দন আর দোয়ায়। উচ্ছ্বসিত আবেগ আর অত্যন্ত কোমল স্বভাবের মানুষ তিনি। তবে তিনি কেবল একজন ইবাদতগুজার বা আবেদ। শরিয়তের ইলম তাঁর ছিল না।

কাঙ্খিত লোকের সন্ধান পেয়ে সে আর দেরি করলো না। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উপাসনালয়ে গিয়ে উপস্থিত হলো। তাঁর মন ছিল ভারাক্রান্ত তাই কোনো ভূমিকা ছাড়া সরাসরি বললো, ‘আমি নিরানব্বইজনকে হত্যা করেছি। এখন আমি তওবা করলে আমার তওবা কবুল হবে কি?’

সে আবেদ এতটাই নরম স্বভাবের ছিল যে, আমার মনে হয় অনিচ্ছায়ও যদি সে একটি পিঁপড়া মেরে ফেলে তাহলে তাঁর সারাদিন অনুশোচনা ও ক্রন্দন করতে করতে কেটে যায়। তাহলে যে ব্যক্তি নিরানব্বইজন নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে, এ ব্যাপারে তাঁর উত্তর কেমন হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

তাঁর কথা শুনে সে আবেদ ভয়ে কেঁপে ওঠল। নিরানব্বইটা লাশ যেন তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠল। সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল। সে ভাবল এতো বড় খুনির আবার মাফ হয় কী করে! তাই সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘না! না! তোমার তওবা কবুল হবে না। তোমার তওবা কবুল হবে না।

অল্পবিদ্যার অধিকারী আবেদের কাছ থেকে এ ধরনের জবাব আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ তাঁর কাছে শরিয়তের ইলম এবং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের জ্ঞান ছিল না। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল আবেগ নির্ভর।

এদিকে বর্বর খুনি লোকটি এ উত্তর শুনে রাগে ক্ষোভে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তাঁর দুচোখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। সঙ্গে সঙ্গে সে তাঁর ছুরি বের করে আবেদকে আঘাত করতে করতে লোকটির দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলল। এরপর সে উপাসনালয় থেকে বের হয়ে গেল। এভাবে সেনর-হত্যার সেঞ্চুরি করলো।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। তাঁর মন আবার তওবার জন্য পাগল হয়ে উঠল। সে আবার বড় কোনো আলেমের সন্ধান করতে লাগল। লোকেরা এবার তাকে একজন বড় আলেমের সন্ধান দিল। সেও তৎক্ষণাৎ তাঁর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো।

এবার লোকটি যার কাছে এসেছে, বাস্তবেই তিনি ছিলেন খুব ওজনদার ব্যক্তি। চেহারায় ছিল প্রজ্ঞা ও খোদাভীতির স্পষ্ট ছাপ। খুনী লোকটি তাকে নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমি একশজনকে হত্যা করেছি। এখন আমি যদি তওবা করি তাহলে আমার তওবা কি কবুল হবে?’

উক্ত আলেম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তোমার তওবার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা নেই? তুমি যেকোনো সময় তওবা করতে পার।’

কত চমৎকার জবাব! আসলেই তো, তওবা করার ক্ষেত্রে তাকে কে বাঁধা দেবে? এক পথভোলা বান্দা মহান পরাক্রমশালী স্রষ্টার দিকে ফিরে যাবে, তাঁর সামনে মাথা নত করবে কার সাধ্য আছে তাকে বাঁধা দেয়ার?

যে আলেমের কাছে লোকটি গিয়েছিল সে আলেম সিদ্ধান্ত দিতেন ইলম ও শরীয়তের ওপর ভিত্তি করে। সিদ্ধান্ত দানের ক্ষেত্রে তিনি নিজের স্বভাব-প্রকৃতি ও আবেগ অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হতেন না।

সে আলেম উক্ত লোকটিকে বললেন, ‘তুমি তো মনে হয় ভাল জায়গায় বসবাস কর না।’

কিভাবে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর বসবাসের জায়গাটা ভাল নয়। মূলত তিনি লোকটির অপরাধের পরিমাণ দেখে এটা বলেছিলেন। কারণ, যেখানে এত বেশি পরিমাণে অপরাধ করা সত্ত্বেও তাকে কেউ বাঁধা দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না, নিশ্চয় সেটা ভাল জায়গা নয়। মূলত তিনি লোকটির অপরাধের পরিমাণ দেখে এটা বলেছিলেন। কারণ, সেখানে এত বেশি পরিমাণে অপরাধ করা সত্ত্বেও তাকে কেউ বাঁধা দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না, নিশ্চয় সেটা ভাল জায়গা নয়।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লোকটি যে এলাকায় থাকে সেখানে জুলুম অত্যাচার, মারামারি ও হানাহানি এত বেশি পরিমাণে হয় যে, মজলুমের পক্ষে কথা বলার মতো কেউ নেই।

তাই তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি তোমার এলাকা ছেড়ে অমুক শহরে চলে যাও । সেখানকার লোকেরা আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করে। তুমি তাদের সঙ্গে থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইবাদত করতে পারবে।’

লোকটি তখনই খাঁটি মনে তওবা করে সে শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো। কিন্তু কিছুদুর যাওয়ার পরে ঘটনাক্রমে পথেই তাঁর মৃত্যু হলো। উদ্দীষ্ট শহরে আর সে উপস্থিত হতে পারল না।

তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে আকাশ থেকে রহমত ও আজাবের দুই দুল ফেরেশতা অবতরণ করলেন। রহমতের ফেরেশতারা বললেন, ‘এ ব্যক্তি খাঁটি মনে তওবা করে ভাল মানুষদের শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। সুতরাং তাঁর রূহ আমরা নিয়ে যাব।’

আর আজাবের ফেরেশতারা বললো, ‘সে তো কখনো কোনো সওয়াবের কাজই করে নি।’ ফিরশতারা যখন এ নিয়ে বাদানুবাদ করছিল তখন মীমাংসার জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষের আকৃতিতে একজন ফেরেশতা পাঠালেন। তিনি এসে যে সিদ্ধান্ত দিলেন তা হলো, ‘ভাল মানুষদের শহরে এবং তাঁর নিজের শহরের মধ্যে কতটুকু দূরত্ব তা নির্ণয় করতে হবে। এরপর দেখতে হবে সে কোনো শহরের নিকটবর্তী। তাঁর ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সে যদি ভাল লোকদের শহরের বেশি নিকটবর্তী হয়ে থাকে তাহলে তাকে ভাল লোক হিসেবে গণ্য করা হবে। ফলে রহমতের ফেরেশতারা তা রূহ নিয়ে যাবে। পক্ষান্তরে সে যদি খারাপ লোকদের শহরের নিকটবর্তী হয়ে থাকে তাহলে আজাবের ফেরেশতারা তাঁর রূহ নিয়ে যাবে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাপজোপ শুর হলো। প্রকৃতপক্ষে সে খারাপ লোকদের এলাকার নিকটবর্তী ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর তওবা কবুল করেছিলেন, তাই তাঁর প্রতি রহমত করতে চাইলেন এবং ভাল লোকদের শহরকে কাছে চলে আসতে আদেশ করলেন, তাঁর খারাপ লোকদের শহরকে বললেন দূরে সরে যেতে। ফেরেশতারা মেপে দেখলেন, লোকটি ভাল লোকদের শহরের বেশি কাছাকাছি। তখন তাকে রহমতের ফেরেশতাদের দায়িত্বে অর্পণ করা হলো।

খেয়াল করে দেখুন, ইলম ও প্রজ্ঞানির্ভর একটি ফতোয়া একজন মানুষের জীবনের মোড় কিভাবে ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু বর্তমানে মুফতীদের অনেককে দেখা যায়, তারা অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে ফতোয়া প্রদান করে থাকেন।

অনেক দিন আগের একটি ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে। আমার এক প্রতিবেশী ছিল। প্রায় স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঝগড়া হতো। একদিন ঝগড়ার চমর পর্যায়ে সে স্ত্রীকে এক তালাক দিয়ে দিল। পরবর্তীতে সে শরিয়তসম্মত প্রত্যাহারের বিশেষ অধিকারবলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলো। কিছুদিন পর একই ঘটনা আবার ঘটল এবং সে একইভাবে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিল। তাঁর সঙ্গে যখনই আমার দেখা হতো, আমি তাকে সতর্ক করতাম। তাকে বারবার তাঁর ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিতাম। আমি তাকে প্রায়ই বলতাম, ‘দেখ, ইতোমধ্যে তুমি তোমার স্ত্রীর ওপর দুটি তালাক প্রয়োগ করে ফেলেছ। তোমার হাতে এখন শুধু একটা তালাক আছে। কখনো যদি এটা প্রয়োগ করে ফেল তাহলে তোমার স্ত্রীকে আর স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আরেকজনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হতে হবে। তারপর সে স্বামী যদি তালাক দেয় তবেই তুমি তাকে বিয়ে করতে পারবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর। তোমার সংসারটা ভেঙ্গে না।’ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন সে আমার কাছে এলো। তাঁর চেহারা ছিল মলিন। তাঁর মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। কোনো মতে সে বললো, ‘জনাব, আবার তাঁর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। একপর্যায়ে আমি তাকে তালাক দিয়ে ফেলেছি!’

তাঁর এ কথায় আমি তেমন আশ্চর্য হই নি। আশ্চর্য হলাম তাঁর পরবর্তী কথায়। সে বললো, ‘আপনি কি উদার প্রকৃতির কোনো মুফতী সাহেবকে চেনেন যে আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার পক্ষে ফতোয়া দেবে?’

তাঁর এ কথায় আমি আশ্চর্য হলাম এবং বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করলাম। একটু আগে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছি, সেটাই তখন আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। অনেক সময় নিজস্ব আবেগ ও অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত মতামত এমনকি অনেকের ফতোয়ারও পরিবর্তন ঘটে।

কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের মধ্যে ধন-সম্পদের লালসা খুব বেশি। তাই তারা যদি সবসময় ধনীদের পেছনে ঘুরে, নিজের মানহানি করে কিংবা সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে নিজের সন্তানদের প্রতি অবহেলা করে তাহলে এটা আশ্চর্যের কোনো বিষয় নয়। কারণ, তারা স্বভাবগতভাবেই লোভী। তাই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাদের এ স্বভাবের প্রভাব পড়ে।

তাই আপনি যদি এ ধরনের লোকের সঙ্গে কোনো লেনদেন করতে চান বা তাঁর থেকে কিছু আদায় করে নিতে চান, তাহলে তাঁর সঙ্গে কথা বলার আগে সবসময় এ বিষয়টি মাথায় রাখবেন যে, লোকটি লোভী প্রকৃতির। তাঁর থেকে আপনার লক্ষ্য অর্জনের সময় লক্ষ্য রাখুন, তাঁর মনের ওপর যেন অতিরিক্ত চান না পড়ে।

উদাহরণ হলো বোঝার চাবিকাঠি। উদাহরণের মাধ্যমে যেকোনো বিষয়ে সহজে বোঝা যায়। তাই এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছি।

মনে করুন, আপনি একদিন হাসপাতালে গেলেন। সেখানে এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আপনার দেখা হলো। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার সহপাঠী ছিল। আপনি তাকে পরদিন মধ্যাহ্ন ভোজে দাওয়াত দিলেন। আর সেও আপনার বাড়িতে আসতে রাজি হলো।

আপনি বাজারে গিয়ে সদাইপত্র কিনলেন। বাড়ি ফিরে আগামীকালের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফোনে আরো কিছু বন্ধুকেও দাওয়াত দিলেন। যেন সবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। মনে করুন, আপনার আমন্ত্রিত বন্ধুদের মধ্যে এক বন্ধু খুব কৃপণ স্বভাবের। ধন-দৌলতের লালসা তাঁর মধ্যে প্রবল। দেখবেন, তাকে যখন আপনি দাওয়াত গ্রহণ করার জন্য বলবেন তখন সে বলবে, ‘আহা! আমার ভাগ্যটা কী খারাপ! খুব জরুরি একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারলে খুবই ভাল হতো! কিন্তু এখন যে আর সেটা সম্ভব নয়। যাই হোক আপনি তাকে আমার সালাম জানাবেন। আমি ওর সঙ্গে পরে সুযোগমতো দেখা করব।’

আপনি যদি তাঁর কৃপণতার কথা আগে থেকে জেনে থাকেন তাহলে তাঁর না আসার কারণও আপনি বুঝতে পারবেন। মূলত সে ভয় পাচ্ছে, যদি সে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসে তাহলে হয়তো সৌজন্যের খাতিরে তাকে নিজের বাড়িতেও খাবারের দাওয়াত দিতে হবে। এর ফলে তাঁর অনেক টাকা খরচ করতে হবে। অথচ তাঁর অভিলাষ হলো সম্পদের পাহাড় গড়া, ব্যয় করে নিঃশেষ করা নয়।

কিন্তু তখন যদি আপনি তাকে জানান যে, আপনার সে বন্ধুর হাতে একদম সময় নেই। সে মধ্যাহ্নভোজ করেই চলে যাবে। অন্য শহরে তাঁর বিশেষ প্রোগ্রাম আছে। তাহলে দেখবেন, সে বলবে, ‘ঠিক আছে। তাহলে আমি এখনই আসছি। আমার সে প্রোগ্রামটা না হয় পিছিয়ে দিচ্ছি।’

আপনার সাথে চলাফেরা করে এমন অনেককে পাবেন, যারা একেবারে নিরিবিলি স্বভাবের। তারা কারো সাথেও নেই পাঁচেও নেই। তাঁর নিজের পরিবারই তাঁর কাছে সবকিছু। পরিবার ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া তার জন্য সম্ভব নয়। নিজের সন্তানদের ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা না বলে আর যা কিছু তাকে করতে বলবেন, সে তা করতে পারবে। অতএব, যেটা তাঁর জন্য সম্ভব নয়, তা তাকে করতে বলবেন না।

এছাড়াও পৃথিবীতে আরো কত স্বভাবের মানুষ আছে।

আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লাগে সেসব মানুষকে যারা অন্যের মন জয় করতে পারে। কৃপণদের সাথে সফর করলে সে তাদের মতো মিতব্যয়ী হয়ে যায়। ফলে কৃপণরাও তাকে পছন্দ করে। আবেগপ্রবণ ব্যক্তিদের সাথে ওঠা-বসা করলে সে তাঁর আবেগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে আবেগী ব্যক্তিরাও তাকে ভালবাসে। রসিক ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করলে সেও হেসে খেলে রসিকতা করে সময় কাটায়। ফলে রসিক লোকেরাও তাকে পছন্দ করে।

মোটকথা, তারা যে পরিবেশে যায় সে পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। অনুকুল-প্রতিকূল ও আনন্দ-বেদনা নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রেই তারা মিশে যেতে পারে।

আসুন সিরাতের পাতাটা উল্টিয়ে একটু পেছনে ফিরে যাই। দেখে আসি নববী যুগের কিছু ঘটনা।

রাসূল (সাঃ) সাহাবীদের নিয়ে মক্কাবিজয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। মক্কায় প্রবেশ করার আগেই মক্কার সরদার আবূ সুফিয়ান রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে আলাপ আলোচনার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন।

আবূ সুফিয়ান (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পর আব্বাস (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বলবেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‘আবূ সুফিয়ান নিজে সরদার মানুষ, আর সরদাররা নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করতে ভালবাসে। তাই তাঁর বড়ত্ব প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা করে দিন।’

তখন রাসূল (সাঃ) মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, ‘যে ব্যক্তি আবূ সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ। যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, সেও নিরাপদ। আর যে মসজিদে হারামে আশ্রয় নেবে, সেও নিরাপদ।’

আবূ সুফিয়ান (রাঃ) যখন মক্কায় ফিরে যেতে উদ্যত হলেন, রাসূল (সাঃ) তাঁর দিকে তাকালেন। রাসূল (সাঃ)_এর স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠল অতীতের কিছু ঘটনা। আবূ সুফিয়ানের কিছু অতীত কর্মকাণ্ড। এ তো সেই আবূ সুফিয়ান, যে কোরাইশের লোকদেরকে বদর প্রান্তরে যুদ্ধ করতে নিয়ে এসেছিল। ওহুদের যুদ্ধেও সে-ই বিশাল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিল। খন্দকের যুদ্ধেও তাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এই সেই সেনাপতি, বহু যুদ্ধের নায়ক। যুদ্ধে যুদ্ধে কেটে গেছে যার জীবনের সিংহভাগ। এই মাত্র তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাই রাসূল (সাঃ) তাকে ইসলামের শৌর্য-বীর্য ও ক্ষমতা দেখাতে চাইলেন।

রাসূল (সাঃ) আব্বাসকে ডাকলেন। আব্বাস (রাঃ) সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উপস্থিত।’

রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘মুসলিম বাহিনী যে গিরিপথ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করছে সে সরু গিরিপথটি এক প্রান্তে আপনি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে দাঁড়াবেন।’ আব্বাস (রাঃ) আবূ সুফিয়ানকে নিয়ে সেখানে দাঁড়ালেন। সেখান দিয়ে মুসলিম বাহিনী ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলছিল মক্কার দিকে। প্রত্যেক দলের সামনে ছিল একটি করে পতাকা। প্রথম সৈন্যদলটি যখন অতিক্রম করলো, আবূ সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্বাস! এরা কারা?’

আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘এরা সুলাইম গোত্রের লোক।’

আবূ সুফিয়ান বললেন, ‘সুলাইম গোত্র দিয়ে আমি কী করব!’

এরপর দ্বিতীয় দলটি অতিক্রম করলো। আবূ সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কারা?’

আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘এরা মুজাইনা গোত্রের লোক।’

আবূ সুফিয়ান (রাঃ) বললেন, ‘মুজাইনা গোত্রের লোক দিয়ে আমার কী হবে?

এভাবে একের পর এক সবগুলো দল চলে গেল। প্রত্যেকটি দল যাওয়ার সময় আবু সূফিয়ান (রাঃ) তাদের পরিচয় জানতে চাচ্ছিলেন আর আব্বাস রাযি যখন পরিচয় দিচ্ছিলেন, তখন তিনি বলছিলেন, ‘এ গোত্রের লোক দিয়ে আমার কী হবে?

সর্বশেষ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অতিক্রম করলেন এক বিশাল সবুজ বাহিনী নিয়ে। তাদের শরীর ছিল লৌহবর্মে আবৃত। বর্মের ফাঁক দিয়ে শুধু তাদের চোখ দু’টোই দেখা যাচ্ছিল। এ সৈন্যদলটি ছিল মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত। আবূ সুফিয়ান এ দলটি দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। এরপর হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘সুবহানাল্লাহ! আব্বাস এটা কোন দল?

আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘এটা হলো রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্বে আনসার ও মুজাহির সাহাবীদের সমন্বয়ে গঠিত সেনাদল।’

আবূ সুফিয়ান (রাঃ) বললেন, ‘এরা তো সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। আল্লাহর কসম! এদের মোকাবিলা করার সাধ্য কারো নেই।

এরপর সে বললো: হে আবূল ফজল! (আব্বাস রাঃ এর উপনাম) তোমার ভাতিজা তো বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে গেছে।’

আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘আবূ সুফিয়ান! এটা সাম্রাজ্য নয়, এটা নবুয়ত।’ আবূ সুফিয়ান (রাঃ) বললেন, ‘নবুয়ত! হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।’

যখন সব বাহিনী তাদেরকে অতিক্রম করে চলে গেল তখন আব্বাস (রাঃ) আবূ সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘আবূ সুফিয়ান’!  তোমার সম্প্রদায়কে বাঁচাও। আবূ সুফিয়ান দ্রুত মক্কায় চলে গেলেন। সেখানে তিনি উচ্চ স্বরে ঘোষণা করতে লাগলেন, ‘হে কোরাইশ সম্প্রদায়! মুহাম্মদ (সাঃ) বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উপকণ্ঠে উপস্থিত। তাঁর মোকাবিলা করার সাধ্য তোমাদের কারো নেই। সুতরাং যে আমার ঘরে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ।’

 তারা বললো, ‘কি বলছ তুমি। তোমার ঘরে কী সবার জায়গা হবে?’

আবূ সুফিয়ান বললেন, ‘আর যে ব্যক্তি নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সেও নিরাপদ। যে মসজিদে হারামে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ।’

তখন লোকেরা কেউ নিজের ঘরে আর কেউ মসজিদে আশ্রয় নিলো।

সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর নবীর কী অপূর্ব বিচক্ষণতা! কী অভিনব কৌশল, তিনি আবূ সুফিয়ান (রাঃ)-এর মনে প্রভাব ফেললেন। তাঁর ওপর রাসূল (সাঃ) ইসলামের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের যে কৌশলটি প্রয়োগ করেছিলেন, সেটিই ছিল তাকে দুর্বল করার সবচেয়ে উপযোগী ও কার্যকরী কৌশল।

এ আলোচ্য বিষয়ের সারকথা হলো, আপনি কারো সঙ্গে কথা বলার আগেই তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি ও পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানতে পারেন তাহলে তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, কীভাবে কথা বলতে হবে তা নির্ণয় করা আপনার জন্য সহায়ক হবে।

গজওয়ায়ে হুদাইবিয়ার ঘটনা। রাসূল (সাঃ) ওমরা করার উদ্দেশ্যে মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের নিয়ে রওয়ানা হয়েছেন। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকজন। সব মিলিয়ে কাফেলায় চৌদ্দশ সদস্য। প্রত্যেকে ওমরার এহরাম বেঁধে কুরবানীর পশু সঙ্গে করে এনেছেন, যাতে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তারা শুধু ওমরার নিয়তেই এসেছেন। রাসূল (সাঃ) নিজে সত্তরটি উট নিয়ে এসেছেন হেরেম শরীফে জবাই করার জন্য।’

হেরেম শরীফ
ছবিঃ মসজিদুল আল হারাম। উৎস: Pixabay

রাসূল (সাঃ) যখন মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছলেন তখন কোরাইশরা তাদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাঁধা দিল। রাসূল (সাঃ) সাহাবীদের নিয়ে হুদাইবিয়া নামক স্থানে তাবু গাড়লেন।

কোরাইশরা সংলাপের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর কাছে একের পর এক প্রতিনিধি পাঠাতে লাগল। সর্বপ্রথম তারা মিকরায বিন হাফসকে পাঠাল। মিকরায কোরাইশ গোত্রের লোক হলেও অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে অবিচল ছিল না। সে ছিল ধুর্ত প্রকৃতির লোক। রাসূল (সাঃ) তাকে আসতে দেখেই বললেন, এ লোকটি ধোঁকাবাজ।’

যখন সে কাছে এসে পৌঁছল, রাসূল (সাঃ) তাঁর উপযোগী কথাই তাকে বললেন। তাকে বললেন, ‘দেখ, আমরা যুদ্ধ করতে আসি নি। আমরা শুধু ওমরাহ করার জন্য এসেছি। তাঁর সঙ্গে রাসূল (সাঃ) কোনো রকমের সন্ধি বা চুক্তি করলেন না। কারণ তিনি জানতেন, সে এর উপযুক্ত নয়।

কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিকরায কোরাইশদের কাছে ফিরে গেল। মিকরাযের পর কোরাইশরা আহাবিশ গোত্রের সরদার হালিস বিন আলকামাকে পাঠালো। আহাবিশ ছিল এমন এক গোত্র, যারা হেরেম শরীফের সম্মান রক্ষার স্বার্থে মক্কায় অবস্থান করত এবং কাবাঘরের দেখা-শোনা করত।

রাসূল (সাঃ) তাকে আসতে দেখে বললেন, ‘তিনি ইবাদতগুযার সম্প্রদায়ের লোক। তাই তোমরা নিজেদের কোরবানীর পশুগুলোকে সামনে নিয়ে এসো, যাতে সে পশুগুলো দেখতে পায়।’

যখন হুলাইস দেখলো, হেরেম শরীফে জবাই করার জন্য প্রস্তুত অংসখ্য পশু উপত্যাকায় চরে বেড়াচ্ছে, ক্ষুৎপিপাসায় পশুগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে তখন সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল। রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে দেখা না করেই সে ফিরে গেল। কারণ সে নিশ্চিত ছিল যে, তারা একমাত্র ওমরা করার জন্যই এখানে এসেছে। আর ওমরাহ করতে আসা লোকদেরকে বাঁধা দেয়ার সংলাপে তিন কীভাবে অংশ নেবেন? সে কোরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বিষয়টি জানাল। কোরাইশ নেতারা তার কথা শুনে বললো, ‘তুমি এখানে বসে থাক। তুমি তো একজন বেদুঈন। এসব রাজনীতির বিষয় তুমি বুঝবে না।’

এমন অপমানজক কথায় হালিস খুব রেগে গেল। সে বললো, ‘হে কোরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা শুনে রাখো, লোকদের বাইতুল্লাহর জিয়ারতে আসতে চাইলে তোমরা বাঁধা দেবে এ জন্য তোমাদের সঙ্গে আমরা মৈত্রীচুক্তি করিনি। বাইতুল্লাহর সম্মানে যে জিয়ারত করতে আসবে, তাকে কেন বাঁধা দেয়া হবে? আমার জান যার হাতে সে সত্তার কসম! মুহাম্মদকে ওমরাহ করার সুযোগ করে দাও। নতুবা আমি আমার গোত্রের সবাইকে নিয়ে চলে যাব।’

কোরাইশরা বললো, ‘তুমি শান্ত হও। আমাদের সমস্যাটা আমাদেরকেই সমাধান করতে দাও।’ এ পর্যায়ে তারা সম্ভ্রান্ত কাউকে প্রতিনিধি করে পাঠাতে চাইল। এবার তারা উরওয়া বিন মাসউদ সাকাফীকে নির্বাচন করলো। উরওয়া বললো, ‘হে কোরাইশ সম্প্রদায়! আমি দেখেছি, ইতোপূর্বে যারাই মুহাম্মদের (সাঃ)-এর কাছে যাওয়ার পর আপনাদের কাছে ফিরে এসেছে, তারাই আপনাদের তিরস্কার ও ধিক্কারের শিকার হয়েছে। আর আপনারা জানেন আমি আপনাদের পুত্র সমতুল্য এবং আপনারা আমার পিতা-সমতুল্য। ’

কোরাইশ নেতারা বললো, ‘তুমি সত্য বলেছ। তোমার ব্যাপারে আমরা সংশয়মুক্ত।’

উরওয়া ছিল গোত্রের সরদার। গোত্রে যেমন ছিল তাঁর সম্মান, তেমনই ছিল তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি। সবার মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। উরওয়া রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে একেবারে রাসূল (সাঃ)-এর সামনে বসল।

এরপর সে রাসূল (সাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললো, ‘মুহাম্মদ! তুমি তো ইতর প্রকৃতির ও নিম্নমানের কিছু মানুষ একত্রিত করেছ। তাদেরকে নিয়েই তুমি তোমার জন্মভূমি জয় করতে আসলে? আরে! শুনে রাখ, এরা হলো কোরাইশ। এদের সঙ্গে আছে বিরাট সৈন্যদল। তারা আজ বাঘের ন্যায় ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। তারা আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বলপ্রয়োগ করে তুমি কিছুতেই মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না। আল্লাহর শপথ! আমি তো দেখছি আগামীকাল যখন যুদ্ধ শুরু হবে তখন এরা তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’

আবু বকর (রাঃ) রাসূলের পিছনে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি উরওয়ার একথা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি গালি দিয়ে বললেন, ‘লাত দেবতার আণ্ডা চোষ! নরাধম তুই কিভাবে ধারণা করলি আমরা তাকে ছেড়ে চলে যাব?

আবু বকরের গালি শুনে সাকাফী গোত্রপ্রধান থ বনে গেল। কিন্তু এমন উত্তর শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আসলে সে এমন কিছু শোনারই উপযুক্ত ছিল। কথায় বলে, যেমন কুকুর তেমন মুগুর। এমন অপ্রত্যাশিত আঘাত না পড়লে তাঁর মাথা থেকে অহংকার নামত না।

উরওয়া থমকে গিয়ে বললো, ‘মুহাম্মদ! এ কে?’

রাসূল বললেন, ‘ইনি আবু কোহাফার পুত্র!’

উরওয়া বললো, ‘আল্লাহর শপথ! আমার ওপর যদি তোমার কোনো অনুগ্রহ না থাকত, তাহলে আজ আমি এর জবাব দিতাম। সে অনুগ্রহের ঋণ আজকের এ অপমানের মাধ্যমে শোধ হয়ে গেল!’

এরপর থেকে উরওয়া নরম স্বরে বলতে লাগল। তবে সে কথা বলার সময় বারবার রাসূল (সাঃ)-এর দাঁড়ির দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। মুগির (রাঃ) প্রথম তলোয়ারের প্রান্ত দ্বারা আস্তে তাঁর হাতে খোঁচা দিলেন। উরওয়া যখন দ্বিতীয়বার হাত বাড়াল, মুগিরা (রাঃ) তলোয়ার দ্বারা তা সরিয়ে দিলেন। তৃতীয়বার সে হাত  বাড়ালে মুগীর (রাঃ) বললেন, ‘তুমি যদি চাও যে, তোমার হাতটি অক্ষত থাকুক তাহলে রাসূলের মুখের কাছ থেকে তা সরিয়ে নাও।’

উরওয়া চমকে উঠে বললো, ‘তোমার ধ্বংস হোক! তুমি কত বড় অভদ্র! মুহাম্মাদ! এ কে?’

রাসূল (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, ‘এ তোমার ভাতিজা মুগির বিন শো’বা সাকাফী।’

উরওয়া বললো, ‘হে বিশ্বাসঘাতক! এ তো কয়দিন আগে তোকে কোলে পিঠে করে মানুষ করলাম, তোর পেশাব-পায়খানা পরিস্কার করলাম। আর তুই আজ আমাকে এমন কথা বলতে পারলি?

উরওয়া উঠে দাঁড়াল এবং কোরাইশদের কাছে ফিরে এসে রাসূল (সাঃ) যা বলেছেন তা জানাল। সে বললো, ‘হে কোরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! আমি পারস্যের সম্রাট কিসরাকে এবং রোমের সম্রাট কায়সারকেও দেখেছি এবং আবিসিনিয়ার সম্রাট নেগাসকেও দেখেছি। তবে মুহাম্মদকে তাঁর সহচরগণ যতটুকু সম্মান ও সমীহ করে থাকে আমি কোনো বাদশাহর অনুচরকর্তৃক বাদশাহকে তত সম্মান করতে দেখি নি।

এ কথা শুনে কোরাইশদের মনে রাসূল (সাঃ)-এর প্রভাব ও বড়ত্ব তৈরি হলো। এ পর্যায়ে তারা সাহল ইবনে আমরকে প্রতিনিধি করে পাঠাল। রাসূল (সাঃ) তাকে দেখে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এবার তোমাদের বিষয়টা সহজে নিস্পত্তি হবে।’ এরপরই দু’দলের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি পত্র স্বাক্ষরিত হলো।

এমনই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর মানুষ চেনার দক্ষতা এবং প্রত্যেকের সঙ্গে তাদের উপযুক্ত চাবি ব্যবহার করে আচরণ করার কৌশল।

মানুষের স্বভাবের ভিন্নতা সহজাত। যে কারো সঙ্গে কথাবার্তা বা অন্য কোনো কাজ করতে গিয়ে আপনি এটা উপলব্ধি করতে পারবেন। ইচ্চা করলে আপনি নিজেও বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যেমন, কোনো বৈঠকে আপনি একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা বর্ণনা করুন। এরপর শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করুন। দেখবেন একের জনের প্রতিক্রিয়া একেক রকম হবে।

আমি একদিন এক সভায় ওমর (রাঃ)-এর শাহাদাতের ঘটনা বর্ণনা করেছিলাম। অগ্নিপূজক আবূ লু’ লু’ কর্তৃক ওমর (রাঃ)-কে ছুরিকাঘাত করার প্রসঙ্গে যখন পৌঁছলাম তখন একটু একটু জোরে বললাম, হঠাৎ আবু লু’লু মেহরাবের কাছ থেকে সামনে অগ্রসর হলো। এরপর আচমকা ওমর (রাঃ)-কে খঞ্জর দ্বারা তিনটা আঘাত করলো। প্রথম আঘাত তাঁর বুকে লাগল। দ্বিতীয়টি পেটে। তারপর লু’লু’ শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তৃতীয় আঘাতটি করলো তাঁর নাভীর একটু নিচে। এরপর খঞ্জর টান দিলে তাঁর পাকস্থলীর অংশবিশেষ বের হয়ে এলো।

আমি এ ঘটনা বলার সময় শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিলাম। এ ঘটনা শুনে কেউ চোখ বন্ধ করে ফেলল যেন সে এ মর্মান্তিক দৃশ্যটি স্বচক্ষে দেখছে। কেউ তো এ ঘটনা শুনে কেঁদেই ফেলল। আর কাউকে দেখলাম, স্বাভাবিকভাবে শুনে যাচ্ছে। তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। যেন সে মায়ের কোলে শুয়ে কোনো ঘুমপাড়ানি গল্প শুনছে!

অনুরূপভাবে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিংহ হামযা (রাঃ)-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করুন। কীভাবে তিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হলেন। কীভাবে তাঁর পেট কেটে তাঁর যকৃত বের করে আনা হলো। এরপর তা চিবিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হলো। কীভাবে তাঁর নাক কান কাটা হলো। এরপর দেখুন শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।

জীবনঘনি ‘এ পরীক্ষা থেকে আমি শিক্ষা পেয়েছি যে, প্রত্যেক সমাজে রুক্ষ স্বভাবের কিছু মানুষ আছে যারা কোমলস্বরে ও সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। কথা দিয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করে না।

এ ধরনের এক ব্যক্তি কয়েকজনের সঙ্গে বসে কোনো এক বিক্রেতার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলছিল। কথা প্রসঙ্গে সে বললো, ‘সেই বিক্রেতাটা গাধার মতো মোটা!’ এরপর বললো: ‘একদম এ খালেদের মতো!’ একথা বলে সে তাঁর পাশে বসে থাকা এক ব্যক্তির দিকে ইশারা করলো।

আমি বুঝলাম না একদম গাধার মতো দেখতে লোকটা কীভাবে খালেদের মতো হলো?’

এখানে একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে। ‘মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করার জন্য কি নিজের স্বভাব পরিবর্তন করা সম্ভব?

আমি বলব, হ্যাঁ! অবশ্যই সম্ভব।

ওমরের শাসন ও কঠোরতার কথা সবাই জানে। একবার নিজ স্ত্রীর সঙ্গে জৈনিক ব্যক্তির ঝগড়া হলো। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এখন সে কী আচরণ করবে এটা জানতে সে ওমরের কাছে এলো।

সে ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-এর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজায় করাঘাত করতে যাবে এমন সময় শুনতে পেল, ওমরের স্ত্রী উচ্চস্বরে ওমরকে বকাঝকা করছে, আর ওমর নির্বিকার ভঙ্গিতে স্ত্রীর চিৎকার শুনে যাচ্ছেন। তাঁর কোনো কথার উত্তর দিচ্ছেন না এমনকি তাকে প্রহারও করছেন না।

লোকটি ওমর (রাঃ)_কে না ডেকে দরজা থেকেই ফিরে যেতে উদ্যত হলো। বস্তুত স্ত্রীর সঙ্গে ওমরের এমন ভূমিকা দেখে সে একদম অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওমর (রাঃ) দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বের হয়ে এলেন। লোকটি চলে যাচ্ছিল। তিনি লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসে দেখা না করে চলে যাচ্ছেন কেন?’

লোকটি বললো, ‘আমিরুল মুমিনীন! আমি আপনার কাছে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অভিযোগ করতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনার দরজায় দাঁড়াতে না দাঁড়াতে শুনলাম, আপনার স্ত্রী আপনার সাথে উচ্চস্বরে বাদানুবাদ করছে। তাই অভিযোগ না করেই ফিরে যাচ্ছি।’

ওমর (রাঃ) বললেন, ‘শুন! সে আমার স্ত্রী। আমার শয্যাসঙ্গিনী । আমার খাবার প্রস্তুতকারিনী। আমার কাপড়-চোপড় ধোলাইকারিনী। সে আমার জন্য এতো কিছু করে, তবুও কি তাঁর সামান্য দুর্ব্যবহার আমি সহ্য করব না?’

তবে কিছু মানুষ এমনও আছে যারা কোনো কিছুতেই ঠিক হয় না। এরা মার্জিত আচরণের জন্য কখনো চেষ্টাও করে না। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিৎ হলো, তাদের সঙ্গে কোনো মতে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করা। তাদের দুর্ব্যবহারগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া।

আমার কাছে কেউ কেউ তাঁর বাবার অতিরিক্ত রাগের কিংবা স্ত্রীর কৃপণতার ব্যাপারে অভিযোগ করে। আরো কতজন কতরকম অভিযোগ নিয়ে আসে! আমি তাদেরকে সংশোধনের কিছু পদ্ধতি ও আচরণকৌশল বলে দিই। তারা আমাকে জানায়, তারা এগুলো প্রয়োগ করেছে কিন্তু সুফল পায় নি, তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এর সমাধান কী?

সমাধান হলো, তাদের দুর্ব্যবহারগুলো সয়ে যেতে হবে। তাদের ভাল আচরণের সমুদ্রে খারাপ আচরণগুলোর সলিলসমাধি দিয়ে দেবে। যথাসম্ভব তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করবে।

কিছু সমস্যা আছে, মানুষের হাতে যার কোনো সমাধান নেই।

ফলাফল…

যার সঙ্গে আপনি চলাফেরা করেন তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি জানতে পারলে আপনি সহজে তাঁর ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবেন। 

উৎস : জীবনকে উপভোগ করুন বই থেকে। 

এরপর পড়ুন : 

For more update please follow our Facebook, Twitter, Instagram , Linkedin , Pinterest , Tumblr And Youtube channel.

Leave a Comment